google.com, pub-9578994771857186, DIRECT, f08c47fec0942fa0 1:1. Al-Fatiha. Ibn Kathir (Bangla) - PDF BOOKS

Header Ads

Header ADS

1:1. Al-Fatiha. Ibn Kathir (Bangla)

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيم (١)

অনুবাদঃ ডঃ মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান


পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)।

তাফসীর ইবনে কাছিরঃ

এই সূরাটির নাম ‘সূরা-ই-আল ফাতিহাহ্। কোন কিছু আরম্ভ করার নাম ‘ফাতিহাহ’ বা উদ্ঘাটিকা। কুরআন কারীমের মধ্যে প্রথম এই সূরাটি লিখিত হয়েছে বলে একে সূরা-ই-আল ফাতিহাহ্ বলা হয়। তাছাড়া নামাযের মধ্যে এর দ্বারাই কিরাআত আরম্ভ করা হয় বলেও একে এই নামে অভিহিত করা হয়েছে। উম্মুল কিতাব’ও এর অপর একটি নাম। জমহুর বা অধিকাংশ ইমামগণ এ মতই পোষণ করে থাকেন। কিন্তু হাসান বসরী (রঃ) এবং ইবনে সীরীন (রঃ) একথা স্বীকার করেন না। তাঁরা বলেন যে, ‘লাও-হি মাহফুয বা সুরক্ষিত ফলকের নামও উম্মুল কিতাব। হাসানের উক্তি এই যে, প্রকাশ্য আয়াতগুলোকে উম্মুল কিতাব বলা হয়। জামেউত তিরমিযীর একটি বিশুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ এই সূরাটি হলো উম্মুল কুরআন, উম্মুল কিতাব, সাবআ মাসানী এবং কুরআন আযীম'। এই সূরাটির নাম ‘সূরাতুল হামদ’ এবং সূরাতুস্ সালাত'ও বটে। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “আমি সালাতকে (অর্থাৎ সূরা-ই-ফাতিহাকে আমার মধ্যে এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে দিয়েছি। যখন বান্দা বলে اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ তখন আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করেছে। এই হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, সূরা-ই-ফাতিহার নাম সূরা- ই-সালাতও বটে। কেননা এই সূরাটি নামাযের মধ্যে পাঠ করা শর্ত রয়েছে। এই সূরার আর একটি নাম সূরাতুশ শিফা। দারিমীর মধ্যে হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে মারফু রূপে বর্ণিত আছে যে, সূরা-ই-ফাতিহা প্রত্যেক বিষ ক্রিয়ায় আঁরেগ্যিদানকারী। এর আর একটি নাম সূরাতুর রকিয়্যাহ'। হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) সাপে কাটা রুগীর উপর ফু দিলে সে ভাল হয়ে যায়। এ দেখে রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ এটা যে রকিয়্যাহ (অর্থাৎ পড়ে ফুঁ দেয়ার সূরা) তা তুমি কেমন করে জানলে?'


হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এ সূরাকে আসাসুল কুরআন বলতেন। অর্থাৎ কুরআনের মূল বা ভিত্তি। আর এই সূরার ভিত্তি হলো بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ সুফইয়ান বিন উয়াইনাহ (রঃ) বলেন যে, এই সূরার নাম অফিয়াহ্। ইয়াহ্ইয়া বিন কাসীর (রাঃ) বলেন যে, এর নাম কাফিয়াও বটে। কেননা, এটা অন্যান্য সূরাকে বাদ দিয়েও একাই যথেষ্ট হয়ে থাকে। কিন্তু অন্য কোন সূরা একে বাদ দিয়ে যথেষ্ট হয় না। কোন কোন মুরসাল (যে হাদীসের সনদের ইনকিতা' শেষের দিকে হয়েছে অর্থাৎ সাহাবীর নামই বাদ পড়েছে এবং তাবেঈ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নাম করে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাকে হাদীসে’ মুরসাল বলে) হাদীসের মধ্যেও একথা এসেছে যে, উম্মুল কুরআন সবারই স্থলাভিষিক্ত হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য সূরাগুলো উম্মুল কুরআনের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। (আল্লামা যামাখশারীর তাফসীর-ই-কাশশাফ দ্রব্য)


একে সূরাতুস সালাত এবং সূরাতুল কাজও বলা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ (রঃ) এবং আবুল আলিয়া (রঃ) বলেন যে, এই সূরাটি মাক্কী। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ), মুজাহিদ (রঃ), আতা’ বিন ইয়াসার (রঃ) এবং ইমাম যুহরী (রঃ) বলেন যে, এই সূরাটি মাদানী। এটাও একটি অভিমত যে, এই সূরাটি দুইবার অবতীর্ণ হয়েছে। একবার মক্কায় এবং অন্যবার মদীনায়। কিন্তু প্রথমটিই বেশী সঠিক ও অভ্রান্ত। কেননা অন্য আয়াতে আছে وَ لَقَدْ اٰتَیْنٰكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِیْ  অর্থাৎ ‘আমি তোমাকে সাবআ মাসানী (বারবার আবৃত্ত সাতটি আয়াত) প্রদান করেছি'।' (১৫:৮৭) আল্লাহ তা'আলাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন।


আবু লাইস সমরকন্দীর (রঃ) একটি অভিমত কুরতুবী (রঃ) এও নকল করেছেন যে, এই সূরাটির প্রথম অর্ধাংশ মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং শেষ অর্ধাংশ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এই কথাটিও সম্পূর্ণ গারীব বা দুর্বল। এ সূরার আয়াত সম্পর্কে সবাই একমত যে ওগুলি ৭টা। কিন্তু আমর বিন উবায়েদ ৮টা এবং হুসাইন যফী ৬টাও বলেছেন। এ দুটো মতই সাধারণ মতের বহির্ভূত ও পরিপন্থী بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ এই সূরাটির পৃথক আয়াত কিনা তাতে মতভেদ রয়েছে। সমস্ত কারী, সাহাবী (রাঃ) এবং তাবেঈর (রঃ) একটি বিরাট দল এবং পরবর্তী যুগের অনেক বয়োবৃদ্ধ মুরব্বী একে সূরা -ই-ফাতিহার প্রথম, পূর্ণ একটি পৃথক আয়াত বলে থাকেন। কেউ কেউ একে সূরা-ই-ফাতিহারই অংশ বিশেষ বলে মনে করেন। আর কেউ কেউ একে এর প্রথমে মানতে বা স্বীকার করতেই চান না। যেমন মদীনা শরীফের কারী ও ফকীহগণের এই তিনটিই অভিমত। ইনশাআল্লাহ পূর্ণ বিবরণ সামনে প্রদত্ত হবে। এই সূরাটির শব্দ হলো পঁচিশটি এবং অক্ষর হলো একশো তেরটি। ইমাম বুখারী (রঃ) সহীহ বুখারীর কিতাবুত তাফসীরের মধ্যে লিখেছেনঃ “এই সূরাটির নাম উম্মুল কিতাব' রাখার কারণ এই যে, কুরআন মাজীদের লিখন এ সূরা হতেই আরম্ভ হয়ে থাকে এবং নামাযের কিরআতও এ থেকেই শুরু হয়। 


একটি অভিমত এও আছে যে, যেহেতু পূর্ণ কুরআন কারীমের বিষয়াবলী সংক্ষিপ্তভাবে এর মধ্যে নিহিত রয়েছে, সেহেতু এর নাম উম্মুল কিতাব হয়েছে। কারণ, আরব দেশের মধ্যে এ প্রথা চালু আছে যে, তারা একটি ব্যাপক কাজ বা কাজের মূলকে ওর অধীনস্থ শাখাগুলির ‘উম্ম’ বা ‘মা’ বলে থাকে। যেমন اُمُّ الرَّاْسِ তারা ঐ চামড়াকে বলে যা সম্পূর্ণ মাথাকে ঘিরে রয়েছে এবং সামরিক বাহিনীর পতাকাকেও তারা اُمُّ বলে থাকে যার নীচে জনগণ একত্রিত হয়। কবিদের কবিতার মধ্যেও একথার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাওয়া যায়। মক্কা শরীফকেও উম্মুল কুরা বলার কারণ এই যে, ওটাই সারা বিশ্ব জাহানের প্রথম ঘর। পৃথিবী সেখান হতেই ব্যাপ্তি ও বিস্তার লাভ করেছে। নামাযের কিরআত ওটা হতেই শুরু হয় এবং সাহাবীগণ কুরআন কারীম লিখার সময় একেই প্রথমে লিখেছিলেন বলে একে ফাতিহাও বলা হয়। এর আর একটি সঠিক নাম ‘সাবআ মাসানীও রয়েছে, কেননা এটা নামাযের মধ্যে বারবার পঠিত হয়। একে প্রতি রাকাতেই পাঠ করা হয়। মাসানীর অর্থ আরও আছে যা ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে বর্ণিত হবে। মুসনাদে-ই-আহমাদের মধ্যে হযরত আবু হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) উম্মুল কুরা' সম্পর্কে বলেছেনঃ 'এটাই উম্মুল কুরআন এটাই সাবআ মাসানী এবং এটাই কুরআনে আযীম। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘এটাই ‘উম্মুল কুরআন, এটাই 'ফাতিহাতুল কিতাব’ এবং এটাই সাবআ মাসানী।


তাফসীর-ই-ইবনে মিরদুওয়াইতে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَ-এর সাতটি আয়াত। بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ ও ওগুলোর মধ্যে একটি আয়াত। এরই নাম সাবআ মাসানী’, এটাই, কুরআনে আযীম, এটাই ‘উম্মুল কিতাব, এটাই ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ এবং এটাই কুরআনে আযীম।


ইমাম দারকুতনীও (রঃ) স্বীয় হাদীস গ্রন্থে এরূপ একটি হাদীস এনেছেন এবং তিনি তার সমস্ত বর্ণনাকারীদেরই নির্ভরযোগ্য বলেছেন। বায়হাকীতে রয়েছে যে, হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এবং হযরত আবু হুরায়রাহ (রাঃ) সাবআ মাসানী’র ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ ‘এটা সূরা-ই-ফাতিহা এবং بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ -এর সপ্তম আয়াত। بِسْمِ اللّٰهِ -এর আলোচনায় এর বর্ণনা পূর্ণভাবে দেওয়া হবে।


হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ আপনার লিখিত কুরআন কারীমের প্রারম্ভে আপনি সূরা-ই-ফাতিহা লিখেননি কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ যদি আমি লিখতাম তবে প্রত্যেক সূরারই প্রথমে ওটাকে লিখতাম। আবু বকর বিন আবি দাউদ (রঃ) বলেনঃ একথার ভাবার্থ এই যে, . নামাযের মধ্যে তা পাঠ করা হয় এবং সমস্ত মুসলমানের এটা মুখস্থ আছে বলে তা’ লিখার আর প্রয়োজন হয় না। দালাইলুন নবুওয়াত’ এ ইমাম বায়হাকী (রঃ) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তাতে রয়েছে যে, এই সুরাটি সর্বপ্রথম অবর্তীণ হয়েছে। বাকিলানীর (রঃ) তিনটি উক্তি বর্ণিত হয়েছেঃ (১) সূরা-ই-ফাতিহা সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। (২) یٰۤاَیُّهَا الْمُدَّثِّرُ সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। (৩) اِقْرَاْ بِاسْمِ সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে। শেষ উক্তিটিই সঠিক। এর পূর্ণ বিবরণ ইনশাআল্লাহ যথাস্থানে আসবে।


 সূরা-ই-ফাতিহার ফযীলত ও মাহাত্ম্যঃ 


মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আবু সাইদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “আমি নামায পড়ছিলাম, এমন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে ডাক দিলেন, আমি কোন উত্তর দিলাম না। নামায শেষ করে আমি তাঁর নিকট উপস্থিত হলাম। তিনি আমাকে বললেনঃ এতক্ষণ তুমি কি কাজ করছিলে? আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি নামাযে ছিলাম। তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা'আলার এই নির্দেশ কি তুমি শুননি?

 یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَجِیْبُوْا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوْلِ اِذَا دَعَاكُمْ 

অর্থাৎ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের (সঃ) ডাকে সাড়া দাও যখন তাঁরা তোমাদেরকে আহ্বান করেন। (৮:২৪) জেনে রেখো, মসজিদ হতে যাবার পূর্বেই আমি তোমাদেরকেই বলে দিচ্ছি, পবিত্র কুরআনের মধ্যে সবচেয়ে বড় সূরা কোটি। অতঃপর তিনি আমার হাত ধরে মসজিদ হতে চলে যাবার ইচ্ছে করলে আমি তাকে তার অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি বললেনঃ ‘ঐ সূরাটি হলো اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَ এটাই সাবআ’ মাসানী এবং এটাই কুরআন আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। এভাবেই এই বর্ণনাটি সহীহ বুখারী শরীফ, সুনান-ই আবি দাউদ এবং সুনান-ই-ইবনে মাজার মধ্যেও অন্য সনদে বর্ণিত হয়েছে। ওয়াকেদী (রঃ) এই ঘটনাটি হযরত উবাই ইবনে কা'বের (রাঃ) বলে বর্ণনা করেছেন। মুআত্তা-ই-ইমাম মালিকে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উবাই ইবনে কা'ব (রাঃ) কে ডাক দিলেন। তিনি নামায পড়ছিলেন। নামায শেষ করে তিনি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি বলেনঃ তিনি (নবী সঃ) স্বীয় হাতখানা আমার হাতের উপর রাখলেন। মসজিদ হতে বের হতে হতেই বললেনঃ আমি চাচ্ছি যে, মসজিদ হতে বের হওয়ার পূর্বেই তোমাকে এমন একটি সূরার কথা বলবো যার মত সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল ও কুরআনে নেই। এখন আমি এই আশায় আস্তে আস্তে চলতে লাগলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম-“হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! সেই সূরাটি কি? তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ নামাযের প্রারম্ভে তোমরা কি পাঠ কর?' আমি বললাম اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَ তিনি বললেনঃ “এই সূরা সেটি। সাবআ’ মাসানী এবং কুরআন আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে তাও এই সূৱাই বটে। এই হাদীসটির শেষ বর্ণনাকারী হলেন আবু সাঈদ (রঃ)। এর উপর ভিত্তি করে ইবনে আসীর এবং তাঁর সঙ্গীগণ প্রতারিত হয়েছেন এবং তাঁকে আবু সাঈদ বিন মুআল্লা মনে করেছেন। এ আবু সাঈদ অন্য লোক, ইনি খাসাইর কৃতদাস এবং তাবেঈগণের অন্তর্ভুক্ত। আর উক্ত আবু সাঈদ আনসারী (রাঃ) একজন সাহাবী। তার হাদীস মুত্তাসিল (যে হাদীসের সনদের মধ্যে কোন স্তরে কোন রাবী বাদ না পড়ে অর্থাৎ সকল রাবীর নামই যথাস্থানে উল্লেখ থাকে তাকে হাদীসে মুত্তাসিল বলে) এবং বিশুদ্ধ। পক্ষান্তরে এই হাদীসটি বাহ্যতঃ পরিত্যাজ্য যদি আবু সাঈদ তাবেঈর হযরত উবাই (রাঃ) হতে শুনা সাব্যস্ত না হয়। আর যদি শুনা সাব্যস্ত হয় তবে হাদীসটি যথার্থতার শর্তের উপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তাআলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন। এই হাদীসটির আরও অনেক সূত্র রয়েছে। মুসনাদ-ই- আহমাদে রয়েছে, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উবাই বিন কা'বের (রাঃ) নিকট যান যখন তিনি নামায পড়ছিলেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)! এতে তিনি (তার ডাকের প্রতি মনোযোগ দেন কিন্তু কোন উত্তর দেন নি। আবার তিনি বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)!' তিনি বলেনঃ ‘আস্সালামু আলাইকা।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ ‘ওয়াআলাইকাস সালাম। তারপর বলেনঃ “হে উবাই (রাঃ)! আমি তোমাকে ডাক দিলে উত্তর দাওনি কেন?' তিনি বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! আমি নামাযে ছিলাম।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তখন উপরোক্ত আয়াতটিই পাঠ করে বলেনঃ তুমি কি এই আয়াতটি শুননি? তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! হাঁ (আমি শুনেছি) এরূপ কাজ আর আমার দ্বারা হবে না।' রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাকে বলেনঃ তুমি কি চাও যে, তোমাকে আমি এমন একটি সূরার কথা বলে দেই যার মত কোন সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং কুরআনের মধ্যেই নেই? তিনি বলেনঃ হ্যা অবশ্যই বলুন।' তিনি বলেনঃ এখান থেকে যাবার পূর্বেই আমি তোমাকে তা বলে দেবো।' অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমার হাত ধরে চলতে চলতে অন্য কথা বলতে থাকেন, আর আমি ধীর গতিতে চলতে থাকি। এই ভয়ে যে না জানি কথা থেকে যায় আর রাসূলুল্লাহ (সঃ) বাড়ীতে পৌছে যান। অবশেষে দরজার নিকট পৌছে আমি তাঁকে তাঁর অঙ্গীকারের কথা স্মরণ করিয়ে দেই।' তিনি বলেনঃ নামাযে কি পড়’ আমি উম্মুল কুরা’ পড়ে শুনিয়ে দেই।' তিনি বলেনঃ “সেই আল্লাহর শপথ যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, এরূপ কোন সূরা তাওরাত, ইঞ্জীল, জবুর এবং কুরআনের মধ্যে নেই। এটাই হলো ‘সাবআ মাসানী'। জামেউত তিরমিযীর মধ্যে আরও একটু বেশী আছে। তা হলো এই যে, এটাই বড় কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে। এই হাদীসটি সংজ্ঞা ও পরিভাষা অনুযায়ী হাসান ও সহীহ। হযরত আনাস (রাঃ) হতেও এ অধ্যায়ে একটি হাদীস বর্ণিত আছে। মুসনাদ-ই-আহমাদেও এইভাবে বর্ণিত আছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) একে পরিভাষার প্রেক্ষিতে হাসান গারীব বলে থাকেন। মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আবদুল্লাহ বিন জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদা আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করি। সে সময় সবেমাত্র তিনি সৌচ ক্রিয়া সম্পাদন করেছেন। আমি তিনবার সালাম দেই কিন্তু তিনি উত্তর দিলেন না। তিনি তো বাড়ীর মধ্যেই চলে গেলেন, আমি দুঃখিত, ও মর্মাহত অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করি। অল্পক্ষণ পরেই পবিত্র হয়ে তিনি আগমন করেন এবং তিনবার সালামের জওয়াব দেন। অতঃপর বলেন, “হে আবদুল্লাহ বিন জাবির (রাঃ)! জেনে রেখো, সম্পূর্ণ কুরআনের মধ্যে সর্বোত্তম সূরা হলো اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَ এই সূরাটি। এর ইসনাদ খুব চমক্কার। এর বর্ণনাকারী ইবনে আকীলের হাদীস বড় বড় ইমামগণ বর্ণনা করে থাকেন। এই আবদুল্লাহ বিন জাবির বলতে আবদী সাহাবীকে (রাঃ) বুঝানো হয়েছে। ইবনুল জাওযীর কথা এটাই। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। হাফিয ইবনে আসাকীরের (রঃ) অভিমত এই যে, ইনি হলেন আবদুল্লাহ বিন জাবির আনসারী বিয়াযী (রাঃ)। 


কুরআনের আয়াত ও সূরাসমূহ এবং ওগুলোর পারস্পরিক মর্যাদা


এই হাদীস এবং এ ধরনের অন্যান্য হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণ বের করে ইবনে রাহ্ইয়াহ, আবু বকর বিন আরবী, ইবনুল হাযার (রঃ) প্রমুখ অধিকাংশ আলেমগণ বলেছেন যে, কোন আয়াত এবং কোন সূরা অপর কোন আয়াত ও সূরার চেয়ে বেশী মর্যাদার অধিকারী। আবার অন্য একদলের ধারণা এই যে, আল্লাহর কালাম সবই সমান। একের উপর অন্যের প্রাধান্য দিলে যে অসুবিধার সৃষ্টি হবে তা হলো অন্য আয়াত ও সূরাগুলি কম মর্যাদা সম্পন্ন রূপে পরিগণিত ও প্রতিপন্ন হবে। অথচ আল্লাহপাকের সমস্ত কালামই সমমর্যাদাপূর্ণ। কুরতুবী এটাই নকল করেছেন আশআরী, আবু বকর বাকিল্লানী, আবু হাতিম ইবনে হাব্বান কূসতী, আবু হাব্বান এবং ইয়াহইয়া বিন ইয়াহইয়া হতে। ইমাম মালিক (রঃ) হতেও এই মর্মের অন্য একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।


সূরা-ই-ফাতিহার মর্যাদার ব্যাপারে উপরোল্লিখিত হাদীসসমূহ ছাড়াও আরও হাদীস রয়েছে। সহীহ বুখারী শরীফের ফাযায়িলুল কুরআন অধ্যায়ে হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ “একবার আমরা সফরে ছিলাম। এক স্থানে আমরা অবতরণ করি। হঠাৎ একটি দাসী এসে বললোঃ “এ জায়গার গোত্রের নেতাকে সাপে কেটেছে। আমাদের লোকেরা এখন সবাই অনুপস্থিত। ঝাড় ফুক দিতে পারে এমন কেউ আপনাদের মধ্যে আছে কি? আমাদের মধ্য হতে একটি লোক তার সাথে গেল। সে যে ঝাড় ফুকও জানতো তা আমরা জানতাম না। তথায় গিয়ে সে কিছু ঝাড় ফুক করলো। আল্লাহর অপার মহিমায় তৎক্ষণাৎ সে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করলো। অনন্তর সে ৩০টি ছাগী দিল এবং আমাদের আতিথেয়তায় অনেক দুধও পাঠিয়ে দিল। সে ফিরে আসলে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলামঃ “তোমার কি এ বিদ্যা জানা ছিল?' সে বললোঃ 'আমিতো শুধু সূরা-ই-ফাতিহা পড়ে ফুক দিয়েছি। আমরা বললামঃ “তাহলে এ প্রাপ্ত মাল এখনও স্পর্শ করো না। প্রথমে ক্লাসূলুল্লাহ (সঃ) কে জিজ্ঞেস করো।' মদীনায় আমরা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কাছে এ ঘটনা আনুপূর্বিক বর্ণনা করলাম। তিনি বললেনঃ “এটা যে ফুক দেয়ার সূরা তা সে কি করে জানলো? এ মাল ভাগ করো। আমার জন্যেও একভাগ রেখো।' সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই আবি দাউদেও এ হাদীসটি রয়েছে। সহীহ মুসলিমের কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, ফুক দাতা হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) ছিলেন।


সহীহ মুসলিম ও সুনান-ই নাসাঈর মধ্যে হাদীস আছে যে, একদা হযরত জিব্রাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকটে বসেছিলেন, এমন সময়ে উপর হতে এক বিকট শব্দ আসলো। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) উপরের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ আজ আকাশের ঐ দরজাটি খুলে গেছে যা ইতিপূর্বে কখনও খুলেনি। অতঃপর সেখান হতে একজন ফেরেশতা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট এসে বললেন, আপনি খুশি হোন! এমন দুটি নূর আপনাকে দেয়া হলো যা ইতিপূর্বে কাউকেও দেয়া হয়নি। তা হলো সূরা-ই-ফাতিহা ও সূরা-ই- বাকারার শেষ আয়াতগুলো। ওর এক একটি অক্ষরের উপর নূর রয়েছে। এটা সুনান-ই-নাসাঈর শব্দ। সহীহ মুসলিমে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি নামাযে উম্মুল কুরআন পড়লো না তার নামায অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ পূর্ণ নয়। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হলোঃ “আমরা যদি ইমামের পিছনে থাকি তা হলে? তিনি বললেনঃ “তাহলেও চুপে চুপে পড়ে নিও। আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) হতে শুনেছি, তিনি বলতেন যে, আল্লাহ ঘোষণা করেনঃ “আমি নামাযকে আমার এবং আমার বান্দার মধ্যে অর্ধ-অর্ধ করে ভাগ করেছি এবং আমার বান্দা আমার কাছে যা চায়। তা আমি তাকে দিয়ে থাকি। যখন বান্দা বলে, اَلۡحَمۡدُ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِيۡنَ তখন আল্লাহ বলেনঃ حَمِدَنِىْ عَبْدِىْ অর্থাৎ আমার বান্দা আমার প্রশংসা করলো’ বান্দা যখন বলে, الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ তখন আল্লাহ বলেনঃ اَثْنٰى عَلَىَّ عَبْدِىْ অর্থাৎ বান্দা আমার গুণাগুণ বর্ণনা করলো। বান্দা যখন বলে, مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ مَجَّدَنِيْ عَبْدِيْ অর্থাৎ আমার বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করলো।' কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, আল্লাহ তা'আলা উত্তরে বলেন فَرَّضَ اِلَىَّ عَبْدِيْ অর্থাৎ ‘বান্দা আমার উপর (সবকিছু) সর্মপণ করলো। যখন বান্দা বলে اِیَّاكَ نَعْبُدُ وَ اِیَّاكَ نَسْتَعِیْنُ তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যেকার কথা এবং আমার বান্দা আমার নিকট যা চাইবে আমি তাকে তাই দেবো' অতঃপর বান্দা শেষ পর্যন্ত পড়ে। তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ “এসব আমার বান্দার জন্যে এবং সে যা কিছু চাইলো তা সবই তার জন্য।' সুনান-ই নাসাঈর মধ্যে এই বর্ণনাটি আছে। কোন কোন বর্ণনার শব্দগুলির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এই হাদীসটিকে পরিভাষা অনুযায়ী হাসান বলেছেন। আবু জারাআ' একে সঠিক বলেছেন। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যেও এ হাদীসটি লম্বা ও চওড়াভাবে রয়েছে। ওর বর্ণনাকারী হচ্ছেন হযরত উবাই বিন কা'ব (রাঃ)। ইবনে জারীরের একটি বর্ণনায় এ হাদীসটির মধ্যে এই শব্দগুলিও রয়েছে যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ ‘এটা আমার জন্য যা অবশিষ্ট রয়েছে তা আমার বান্দার জন্য।' অবশ্য এ হাদীসটি এর উসূল বা মূলনীতির পরিভাষা অনুসারে গারীব বা দুর্বল। 


  আলোচ্য হাদীসের উপকার সমূহ, তৎসম্পর্কিত আলোচনা ও ফাতিহার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য।  


এখন এই হাদীসের উপকারিতা ও লাভালাভ লক্ষ্যণীয় বিষয়। প্রথমতঃ এই হাদীসের মধ্যে صَلٰوةٌ অর্থাৎ নামাযের সংযোজন রয়েছে এবং তার তাৎপর্যও ভাবার্থ হচ্ছে কিরআত। যেমন কুরআনের মধ্যে অন্যান্য জায়গায় রয়েছেঃ وَلَا تَجْهَرْ بِصَلَاتِكَ وَلَا تُخَافِتْ بِهَا وَابْتَغِ بَيْنَ ذٰلِكَ سَبِيْلًا অর্থাৎ স্বীয় নামায (কিরআত) কে খুব উচ্চৈঃস্বরে পড়ো না আর খুব নিম্ন স্বরেও না, বরং মধ্যম স্বরে পড়।' (১৭:১১০) এর তাফসীরে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে প্রকাশ্যভাবে বর্ণিত আছে যে, এখানে صَلٰوةٌ এর অর্থ হলো কিরাআত বা কুরআন পঠন। এভাবে উপরোক্ত হাদীসে কিরাআতকে সালাত বলা হয়েছে। এতে নামাযের মধ্যে কিরাআতের যে গুরুত্ব রয়েছে তা বিলক্ষণ জানা যাচ্ছে। আরও প্রকাশ থাকে যে, কিরআত নামাযের একটি মস্তবড় স্তম্ভ (এ জন্যেই এককভাবে ইবাদতের নাম নিয়ে ওর একটি অংশ অর্থাৎ কিরা'আতকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অপরপক্ষে এমনও হয়েছে যে, এককভাবে কিরাআতের নাম নিয়ে তার অর্থ নামায নেয়া হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা'আলার কথাঃ  وَ قُرْاٰنَ الْفَجْرِؕأِنَّ قُرْاٰنَ الْفَجْرِ كَانَ مَشْهُوْدًا 


অর্থাৎ ‘ফজরের কুরআনের সময় ফেরেশতাকে উপস্থিত করা হয়।' (১৭:৭৮) এখানে কুরআনের ভাবার্থ হলো নামায। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীসে রয়েছে যে, ফজরের নামাযের সময় রাত্রি ও দিনের ফেরেশতাগণ একত্রিত হন। এই আয়াত ও হাদীসসমূহ দ্বারা বিলক্ষণ জানা গেল যে, নামাযে কিরাআত পাঠ খুবই জরুরী এবং আলেমগণও এ বিষয়ে একমত। দ্বিতীয়তঃ নামাযে সূরা-ই ফাতিহা পড়াই জরুরী কি না এবং কুরআনের মধ্য হতে যা কিছু পড়ে নেওয়াই যথেষ্ট কি না এ ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং তাঁর সহচরগণ বলেন যে, নির্ধারিতভাবে যে সূরা ফাতিহাই পড়তে হবে এটা জরুরী নয়। বরং কুরআনের মধ্য হতে যা কিছু পড়ে নেবে তাই যথেষ্ট। তাঁর দলীল হলো فَاقْرَءُوْا مَا تَیَسَّرَ مِنَ الْقُرْاٰنِؕ (৭৩:২০) এই আয়াতটি। অর্থাৎ কুরআনের মধ্য হতে যা কিছু সহজ হয় তাই পড়ে নাও।' সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে যে হাদীস আছে তাতে উল্লেখ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাড়াতাড়ি নামায আদায়কারী এক ব্যক্তিকে বললেনঃ যখন তুমি নামাযের জন্যে দাঁড়াবে তখন তাকবীর বলবে এবং কুরআনের মধ্য হতে যা তোমার নিকট সহজ বোধ হবে তাই পড়বে।' তারা বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) লোকটিকে সূরা ফাতিহা পড়ার কথা নির্দিষ্টভাবে বলেন না এবং যে কোন কিছু পড়াকেই যথেষ্ট বলে মনে করলেন। দ্বিতীয় মত এই যে, সূরা ফাতিহা পড়াই জরুরী এবং অপরিহার্য এবং তা পড়া ছাড়া নামায হয় না। অন্যান্য সমস্ত ইমামের এটাই মত। ইমাম মালিক (রঃ), ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রঃ) এবং তাঁদের ছাত্র ও জমহুর উলামা সবারই এটাই অভিমত। এই হাদীসটি তাঁদের দলীল যা রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি যে কোন নামায পড়লো এবং তাতে উম্মুল কুরআন পাঠ করলো না, ঐ নামায অসম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ-পূর্ণ নয়। এরকমই ঐসব বুযুর্গ ব্যক্তিদের এটাও দলীল যা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি সূরা-ই ফাতিহা পড়ে না তার নামায হয় না।' সহীহ ইবনে খুযাইমাহ্ ও সহীহ ইবনে হিব্বানের মধ্যে হযরত আবু হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “ঐ নামায হয় না যার মধ্যে উম্মুল কুরআন পড়া না হয়। এ ছাড়া আরও বহু হাদীস রয়েছে। এখানে আমাদের বিতর্কমূলক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার তেমন প্রয়োজন নেই। কারণ এ আলোচনা অতি ব্যাপক ও দীর্ঘ। আমরা তো সংক্ষিপ্তভাবে শুধু উপরোক্ত মনীষীর দলীলসমূহ এখানে বর্ণনা করে। দিলাম। এখন এটাও স্মরণীয় বিষয় যে, ইমাম শাফিঈ (রঃ) প্রভৃতি মহান আলেমদের একটি দলের মাযহাব এটাই যে, প্রতি রাকাআতে সূরা-ই-ফাতিহা পড়া ওয়াজিব এবং অন্যান্য লোকের মতে অধিকাংশ রাকআতে পড়া ওয়াজিব। হযরত হাসান বসরী (রঃ) এবং বসরার অধিকাংশ লোকেই বলেন যে, নামাযসমূহের মধ্যে কোন এক রাকাআতে সূরা ফাতিহা পড়ে নেয়া ওয়াজিব। কেননা হাদীসের মধ্যে সাধারণভাবে নামাযের উল্লেখ করা হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা (রঃ) এবং তাঁর অনুসারী সুফিয়ান সাওরী (রঃ) ও আওযায়ী (রঃ) বলেন যে, ফাতিহাকেই নির্দিষ্টভাবে পড়ার কোন কথা নেই বরং অন্য কিছু পড়লেই যথেষ্ট হবে। কারণ পবিত্র কুরআনের মধ্যে مَاتَيَسَّرَ শব্দটি রয়েছে। আল্লাহ তাআলাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখা উচিত যে, সুনান-ই-ইবনে মাজায় রয়েছেঃ 'যে ব্যক্তি ফরয ইত্যাদি নামাযে সূরা-ই-ফাতিহা এবং অন্য সূরা পড়লো না তার নামায হলো না। তবে অবশ্যই এ হাদীসটির বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। এসব কথার বিস্তারিত আলোচনার জন্যে শরীয়তের আহকামের বড় বড় কিতাব রয়েছে। আল্লাহ তা'আলাই এসব ব্যাপারে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ জ্ঞানের অধিকারী।


তৃতীয়তঃ মুকতাদীগণের উপর সূরা-ই-ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হওয়ার প্রশ্নে আলেমদের তিনটি অভিমত রয়েছে। 


(১) সূরা ফাতিহা পাঠ ইমামের উপর যেমন ওয়াজিব, মুকতাদির উপরও তেমনই ওয়াজিব।


(২) মুকতাদির উপর কিরাআত একবারেই ওয়াজিব নয়। সূরা ফাতিহাও নয় এবং অন্য সূরাও নয়। তাদের দলীল-প্রমাণ মুসনাদ-ই-আহমাদের সেই হাদীসটি, যার মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যার জন্যে ইমাম রয়েছে, ইমামের কিরাআতই তার কিরাআত। কিন্তু বর্ণনাটি হাদীসের পরিভাষায় একান্ত দুর্বল এবং স্বয়ং এটা হযরত জাবিরের (রাঃ) কথা দ্বারা বর্ণিত আছে। যদিও এই মারফু (যে হাদীসের সনদ রাসূলুল্লাহ (সঃ) পর্যন্ত পৌছেছে অর্থাৎ স্বয়ং তাঁর হাদীস বলে সাব্যস্ত  হয়েছে তাকে মারফু হাদীস বলে) হাদীসটির অন্যান্য সনদও রয়েছে, কিন্তু কোন সনদই অভ্রান্ত ও সঠিক নয়। অবশ্য আল্লাহই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানেন। 


(৩) যে নামাযে ইমাম আস্তে কিরাআত পড়েন তাতে তো মুকতাদির উপর কিরাআত পাঠ ওয়াজিব, কিন্তু যে নামাযে উচ্চৈঃস্বরে কিরআত পড়া হয় তাতে ওয়াজিব নয়। তাদের দলীল প্রমাণ হচ্ছে সহীহ মুসলিমের হাদীসটি। তা এই যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “অনুসরণ করার জন্যে ইমাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তাঁর তাকবীরের পরে তাকবীর বল এবং যখন তিনি পাঠ করেন তখন তোমরা চুপ থাক।' সুনানের মধ্যেও এই হাদীসটি রয়েছে। ইমাম মুসলিম (রঃ) এর বিশুদ্ধতা স্বীকার করেছেন। ইমাম শাফিঈরও (রঃ) প্রথম মত এটাই এবং ইমাম আহমদ (রঃ) হতেও এরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে। 


এই সব মাসয়ালা এখানে বর্ণনা করার আমাদের উদ্দেশ্য এই যে, সূরা-ই ফাতিহার সঙ্গে শরীয়তের নির্দেশাবলীর যতটা সম্পর্ক রয়েছে অন্য কোন সূরার সঙ্গে ততটা সম্পর্ক নেই। মুসনাদ-ই-বাজ্জাজের মধ্যে হাদীস রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ 'যখন তোমরা বিছানায় শয়ন কর তখন যদি সূরা-ই-ফাতিহা এবং قُلْ هُوَ اللّٰهُ সূরা পড়ে নাও, তাহলে মৃত্যু ছাড়া প্রত্যেক জিনিস হতে নিরাপদে থাকবে।' 


 ইসতি‘আযাহ বা اَعُوْذُ بِاللّٰهِ ‘আউযুবিল্লাহ’-এর তাফসীর এবং তার আহকাম ও নির্দেশাবলী 


পবিত্র কুরআনে রয়েছেঃ  خُذِ الْعَفْوَ وَ اْمُرْ بِالْعُرْفِ وَ اَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِیْنَ . وَ اِمَّا یَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّیْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِؕ অর্থাৎ ক্ষমা করে দেয়ার অভ্যাস কর, ভাল কাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খদের দিক হতে মুখ ফিরিয়ে নাও, যদি শয়তানের কোন কুমন্ত্রণা এসে যায় তবে সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।' (৭:১৯৯-২০০) অন্য এক জায়গায় বলেছেনঃ اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ السَّیِّئَةَؕ-نَحْنُ اَعْلَمُ بِمَا یَصِفُوْنَ . وَ قُلْ رَّبِّ اَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّیٰطِیْنِ . وَ اَعُوْذُ بِكَ رَبِّ اَنْ یَّحْضُرُوْنِ অর্থাৎ ‘অমঙ্গলকে মঙ্গলের দ্বারা প্রতিহত কর, তারা যা কিছু বর্ণনা করছে তা আমি খুব ভালভাবে জানি। বলতে থাক-হে আল্লাহ! শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং তাদের উপস্থিতি হতে আমরা আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি।' (২৩:৯৬-৯৮)


অন্য এক জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ فَاِذَا الَّذِیْ بَیْنَكَ وَ بَیْنَهٗ عَدَاوَةٌ كَاَنَّهٗ وَلِیٌّ حَمِیْمٌ অর্থাৎ ‘অমঙ্গলকে মঙ্গল দ্বারা পতিহত কর, তাহলে তোমার এবং অন্যের মধ্যে শক্রতা রয়েছে তা এমন হবে যে, যেন সে অকৃত্রিম সাহায্যকারী বন্ধু'। (৪১:৩৪) এ কাজটি ধৈর্যশীল ও ভাগ্যবান ব্যক্তিদের জন্যে। অর্থাৎ যখন কুমন্ত্রণা এসে পড়ে তখন সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞাতা আল্লাহ তা'আলার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর।


এই মর্মে এই তিনটিই আয়াত আছে এবং এই অর্থের অন্য কোন আয়াত নেই। আল্লাহ তা'আলা এই আয়াতসমূহের মাধ্যমে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, মানুষের শক্রতার সবচাইতে ভাল ঔষুধ হলো প্রতিদানে তাদের সঙ্গে সৎ ব্যবহার করা। এরূপ করলে তারা তখন শত্রুতা করা থেকেই বিরত থাকবেন না, বরং অকৃত্রিম বন্ধুতে পরিণত হবে। আর শয়তানদের শত্রুতা হতে নিরাপত্তার জন্যে আল্লাহ তারই নিকট আশ্রয় চাইতে বলছেন। কেননা এই শয়তানরূপী অপবিত্র শক্রদেরকে উত্তম ব্যবহারের দ্বারাও আয়ত্তে আনা কখনো সম্ভব নয়। কারণ সে। মানুষের বিনাশ ও ধ্বংসের মধ্যে আমোদ পায় এবং তার পুরাতন শক্রতা হযরত হাওয়া ও হযরত আদম (আঃ)-এর সময় হতেই অব্যাহত রয়েছে। কুরআন ঘোষণা করছেঃ “হে আদমের সন্তানেরা! তোমাদেরকে যেন এই শয়তান পথভ্রষ্ট ও বিভ্রান্ত না করে ফেলে, যেমন তোমাদের বাপ-মাকে পথভ্রষ্ট করে। চির সুখের জান্নাত হতে বের করে দিয়েছিল। অন্য স্থানে বলা হচ্ছেঃ ‘শয়তান তোমাদের শত্রু, তাকে শত্রুই মনে কর। তার দলের তো এটাই কামনা যে তোমরা দোযখবাসী হয়ে যাও। কি! আল্লাহকে ছেড়ে শয়তানের সঙ্গে এবং তার সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছো? তারা তো তোমাদের পরম শত্রু। জেনে রেখো যে, অত্যাচারীদের জন্যে জঘন্য প্রতিদান রয়েছে। এতো সেই শয়তান যে আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ)কে বলেছিলঃ “আমি তোমার একান্ত শুভাকাংখী। তা হলে চিন্তার বিষয় যে, আমাদের সঙ্গে তার চালচলন কি হতে পারে? আমাদের জন্যেই তো সে শপথ করে বলেছিলঃ মহা সম্মানিত আল্লাহর শপথ! আমি তাদেরকে বিপথে নিয়ে যাবো। তবে হ্যা, যারা তার খাটি বান্দা তারা নিরাপদে থাকবে। এ জন্যে মহান আল্লাহ বলেনঃ فَاِذَا قَرَاْتَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّیْطٰنِ الرَّجِیْمِ 


অর্থাৎ তোমরা কুরআন পাঠের সময় বিতাড়িত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর।' (১৬:৯৮) ঈমানদারগণ ও প্রভুর উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের উপরে তার কোন ক্ষমতাই নেই। আর ক্ষমতা তো শুধু তাদের উপরই রয়েছে যারা তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে এবং আল্লাহ তা'আলার সঙ্গে শিরক করে থাকে। 


কারীদের একটি দল ও অন্যেরা বলে থাকেন যে, কুরআন পাঠের পর اَعُوْذُ بِاللّٰهِ পড়া উচিত। এতে দু'টি উপকার রয়েছে। এক তো হলোঃ কুরআনের বর্ণনারীতির উপর আমল এবং দ্বিতীয় হলোঃ ইবাদত শেষে অহংকার দমন। আবু হাতিম সিজিসতানী এবং ইবনে ফাল্ফা হামযার এই নীতিই নকল করেছেন। যেমন আরুল কাসিম ইউসুফ বিন আলী বিন জানাদাহ (রঃ) স্বীয় কিতাব “আল ইবাদাতুল কামিল’-এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এর ইসনাদ গারীব। ইমাম যারী (রঃ) স্বীয় তাফসীরের মধ্যে এটা নকল করেছেন এবং বলেছেন যে, ইবরাহীম নাখয়ী (রঃ) ও দাউদ যাহেরীরও (রঃ) এই অভিমত। কুরতুবী (রঃ) ইমাম মালিকের (রঃ) মাযহাবও এটাই বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ইবনুল আরাবী একে গারীব বলে থাকেন। একটি মাযহাব এরূপ আছে যে, প্রথমে ও শেষে এই দু’বার اَعُوْذُ بِاللّٰهِ পড়া উচিত। তাহলে দুটি দলীলই একত্রিত হয়ে যাবে। জমহুর উলামার প্রসিদ্ধ মাযহাব এই যে, কুরআন পাঠের পূর্বে اَعُوْذُ بِاللّٰهِ পাঠ করা উচিত, তাহলে কুমন্ত্রণা হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। সুতরাং ঐ বুযুর্গদের নিকট আয়াতের অর্থ হবেঃ “যখন তুমি পড়বে অর্থাৎ তুমি পড়ার ইচ্ছা করবে। যেমন নিম্নের আয়াতটিঃ اِذَا قُمْتُمْ اِلَى الصَّلٰوةِ 


অর্থাৎ যখন তুমি নামায পড়ার জন্যে দাঁড়াও" (তবে ওযু করে নাও)-এর অর্থ হলোঃ যখন তুমি নামাযের জন্য দাঁড়াবার ইচ্ছা কর।' হাদীসগুলোর ধারা অনুসারে এই অর্থটিই সঠিক বলে মনে হয়। মুসনাদ-ই-আহমাদের হাদীসে আছে যে যখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) মামাযের জন্য দাঁড়াতেন তখন اَللّٰهُ اَكْبَرُ বলে নামায আরম্ভ করতেন অতঃপর, سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالٰى جَدُّكَ وَلَااِلٰهَ غَيْرُكَ তিনবার পড়ে لَآ اِلٰهَ اِلَّا اللّهُ ‘লা-ইলাহা-ইল্লাল্লাহ’ পড়তেন। তারপর পড়তেনঃ  اَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ مِنْ هَمْزِهٖ وَنَفْخِهٖ وَنَفْثِهٖ সুনান-ই-আরবার মধ্যেও এ হাদীসটি রয়েছে। ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন যে, এই অধ্যায়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ-হাদীস এটাই। هَمَزٌ শব্দের অর্থ হলো গলা টিপে ধরা, نَفَخٌ শব্দের অর্থ হলো অহংকার এবং نَفَثٌ শব্দের অর্থ হলো কবিতা পাঠ। ইবনে মাজা (রঃ) স্বীয় সুনানে এই অর্থ বর্ণনা করেছেন। তাতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামাযে প্রবেশ করেই اَللّٰهُ اَكْبَرُ كَبِيْرًا তিনবার وَالْحَمْدُ لِلّٰهِ كَثِيْرًا তিনবার এবং তিনবার سُبْحَانَ اللَّهِ بُكْرَةً وَّاَصِيْلًا পাঠ করতেন।অতঃপর اَللّٰهُمَّ اِنِّىْ اَعُوْذُبِكَ مِنَ الشَّيْطَانِ مِنْ هَمْزِهٖ  وَنَفْخِهٖ وَنَفْثِهٖ পড়তেন। 


সুনান-ই-ইবনে মাজাতেও অন্য সনদে এই হাদীসটি সংক্ষিপ্তভাবে এসেছে। মুসনাদ-ই- আহমাদের হাদীসে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) তিনবার اَللّهُ اَكْبَرُ তাকবীর বলতেন। অতঃপর سُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهٖ তিনবার বলতেন। অতঃপর اَعُوْذُ بِاللهِ শেষ পর্যন্ত পড়তেন। মুসনাদে-ই-আবি ইয়ালার মধ্যে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সামনে দুটি লোকের ঝগড়া বেধে যায়। ক্রোধে একজনের নাসারন্ধ্র ফুলে উঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ যদি লোকটি اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়ে নেয় তবে তার ক্রোধ এখনই ঠাণ্ডা ও স্তিমিত হয়ে যাবে।' ইমাম নাসাঈ (রঃ) স্বীয় কিতাব اَلْيَوْمُ وَاللَّيْلَةُ-এর মধ্যেও হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। মুসনাদ-ই-আহমাদ, সুনান-ই-আবি দাউদ এবং জামেউত তিরমিযীর মধ্যেও হাদীসটি রয়েছে; একটি বর্ণনায় আরও একটু বেশী আছে, তা এই যে, হযরত মুআয (রাঃ) লোকটাকে তা পড়তে বলেন। কিন্তু সে তা পড়লো না এবং ক্রোধ উত্তরোত্তর বেড়েই চললো। ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন যে, এই বৃদ্ধি যুক্ত বর্ণনাটি মুরসাল। কেননা আবদুর রহমান বিন আবু লাইলা, যিনি হযরত মুআ (রাঃ) হতে সেটি বর্ণনা করেছেন, হযরত মুআযের (রাঃ) সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হওয়াই সাব্যস্ত হয় না। কারণ তিনি বিশ বছর পূর্বে নশ্বর দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু হতে পারে যে, হয়তো আবদুর রহমান হযরত উবাই বিন কাব (রাঃ) হতে ওটা শুনেছেন। তিনিও এই হাদীসের একজন বর্ণনাকারী এবং তিনি ওটাকে হযরত মুআয পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়েছেন। কেননা, এ ঘটনার সময় তো বহু সাহাবী (রাঃ) বিদ্যমান ছিলেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুনান-ই- আবি দাউদ এবং সুনা-ই-নাসাঈর মধ্যেও বিভিন্ন সনদে এবং বিভিন্ন শব্দে এ হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। এ সম্পর্কে আরও হাদীস রয়েছে। এখানে সমস্ত কিছু বর্ণনা করলে আলোচনা খুব দীর্ঘায়িত হয়ে যাবে। এ সবের বর্ণনার জন্য যিকর, ওযীফা এবং আমলের বহু কিতাব রয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলাই খুব বেশী জানেন। 


একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, হযরত জিব্রাঈল (আঃ) সর্বপ্রথম যখন প্রত্যাদেশ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নিকট আগমন করেন তখন প্রথমে اَعُوْذُ بِاللهِ পড়ার নির্দেশ দেন। তাফসীর-ই-ইবনে জারীরে হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, প্রথম দফায় হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নিকট ওয়াহী এনে বলেনঃ “আঊযু পড়ুন।' তিনি পাঠ اَسْتَعِيْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ করেন। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) পুনরায় বলেনঃ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পাঠ করুন। তারপরে বলেনঃ اِقْرَاْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِیْ خَلَقَ অর্থাৎ যিনি আপনাকে সৃষ্টি করেছেন আপনার সেই প্রভুর নামে পাঠ করুন। 


হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বলেন যে, সর্বপ্রথম সূরা-যা আল্লাহ তা'আলা হযরত জিব্রাঈলের (আঃ) মাধ্যমে হযরত মুহাম্মদ (রাঃ)-এর উপর অবতীর্ণ করেন তা এটাই। কিন্তু হাদীসটি গারীব এবং এর সনদের মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। শুধু জেনে রাখার জন্যেই এখানে এটা বর্ণনা করলাম। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলাই ভাল জানেন।


 ‘মাসআলাহ’ বা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য বিষয়ঃ 


জামহুর উলামার মতে ‘ইসতি‘আযাহু’ বা ‘আঊযুবিল্লাহ' পড়া মুসতাহাব, ওয়াজিব নয়। সুতরাং তা না পড়লে পাপ হবে না। আ’তা বিন আবি রিবাহের (রঃ) অভিমত এই যে, কুরআন পাঠের সময় আঊযু পড়া ওয়াজিব-নামাযের মধ্যেই হোক বা নামাযের বাইরেই হোক। ইমাম রাযী (রঃ) এই কথাটি নকল করেছেন। ইবনে সীরীন (রঃ) বলেন যে, জীবনে একবার মাত্র পড়লেই কর্তব্য পালন হয়ে যাবে। হযরত আতার (রঃ) কথার দলীল প্রমাণ হলো আয়াতের প্রকাশ্য শব্দগুলো। কেননা, এতে فَاسْتَعِذْ শব্দটি ‘আমর’ বা নির্দেশ সূচক ক্রিয়াপদ। আর আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী আমর’ অবশ্যকরণীয় কার্যের জন্যেই ব্যবহৃত হয়। ঠিক দ্রুপ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর সদা সর্বদা এর উপর আমলও তা অবশ্যকরণীয় হওয়ার দলীল। এর দ্বারা শয়তানের দুষ্টুমি ও দুস্কৃতি দূর হয় এবং তা দূর হওয়াও একরূপ ওয়াজিব। আর যা দ্বারা ওয়াজিব পূর্ণ হয় সেটাও ওয়াজিব হয়ে দাঁড়ায়। আশ্রয় প্রার্থনা অধিক সতর্কতা বিশিষ্ট হয়ে থাকে এবং অবশ্যকরণীয় কাজের এটাও একটা পন্থা বটে। কোন কোন আলেমের কথা এই যে, “আউযু' পাঠ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপরই ওয়াজিব ছিল, তার উম্মতের উপর ওয়াজিব নয়। ইমাম মালিক (রঃ) হতে এটাও বর্ণনা করা হয় যে, ফরয নামাযের নয় বরং রামাযান শরীফের প্রথম রাত্রির নামাযে ‘আউযু' পড়া উচিত।


 জিজ্ঞাস্যঃ 


ইমাম শাফিঈ (রঃ) স্বীয় ইমলা’র মধ্যে লিখেছেন যে, আউযুবিল্লাহ জোরে সশব্দে পড়তে হবে কিন্তু আস্তে পড়লেও তেমন কোন দোষ নেই। ইমাম শাফিঈ (রঃ) স্বীয় কিতাবুল উম্ম’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থে লিখেছেন যে, জোরে ও আস্তে উভয়ভাবেই পড়ার অধিকার রয়েছে। কারণ হযরত ইবনে উমর (রঃ) হতে ধীরে পড়ার এবং হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে উচ্চৈঃস্বরে পড়ার কথা সাব্যস্ত আছে। প্রথম রাকআত ছাড়া অন্যান্য রাকআতে আউযুবিল্লাহ পড়ার ব্যাপারে ইমাম শাফিঈর (রঃ) দু’টি মত রয়েছে। প্রথমটি মুসতাহাব হওয়ার এবং দ্বিতীয়টি মুসতাহাব না হওয়ার। প্রাধান্য দ্বিতীয় মতের উপরই রয়েছে। আল্লাহ তা'আলাই সঠিক ও সুষ্ঠু জ্ঞানের অধিকারী। 


ইমাম শাফিঈ (রঃ) ও ইমাম আবু হানীফার (রঃ) নিকট শুধু اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়াই যথেষ্ট। কিন্তু কেউ কেউ বলেন যে, اَعُوْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়তে হবে। আবার কেউ বলেনঃ اَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ اِنَّ اللّٰهَ هُوَ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ পাঠ করতে হবে। সাওরী (রঃ) এবং আওযায়ীর (রঃ) এটাই মাযহাব। কেউ কেউ আবার বলেন যে, اَسْتَعِيْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ পড়তে হবে। তা হলে আয়াতের সমস্ত শব্দের উপর আমল হয়ে যাবে এবং তার সাথে হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) হাদীসের উপর আমল করা হবে। একথা পূর্বেও বলা হয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে যেসব বিশুদ্ধ হাদীস ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে ঐগুলোই অনুসরণের পক্ষে সর্বোত্তম। আল্লাহ তাআলাই এসব ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল জানেন।


ইমাম আবু হানিফা (রঃ) ও ইমাম মুহাম্মাদের (রঃ) মতে নামাযের মধ্যে আউযুবিল্লাহ পড়া হয় তিলাওয়াতের জন্য। আর ইমাম আবু ইউসুফের (রঃ) মতে নামাযের জন্য পাঠ করা হয়। সুতরাং মুকতাদীরও পড়ে নেয়া উচিত যদিও সে কিরআত পড়ে না। ঈদের নামাযেও প্রথম তাকবীরের পর পড়ে নেয়া দরকার। জমহুরের মাযহাব এই যে, ঈদের নামাযে সমস্ত তাকবীর বলার পর আউযুবিল্লাহ পড়তে হবে, তারপর কিরআত পড়তে হবে। আউযুবিল্লাহের মধ্যে রয়েছে বিস্ময়কর উপকার ও মাহাত্ম্য। আজে বাজে কথা বলার ফলে মুখে যে অপবিত্রতা আসে তা বিদূরিত হয়। ঠিক দ্রুপ এর দ্বারা মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা হয় এবং তার ব্যাপক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার কথা স্বীকার করা হয়। আর আধ্যাত্মিক প্রকাশ্য শত্রুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় স্বীয় দুর্বলতা ও অপারগতার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়। কেননা মানুষ শক্রর মুকাবিলা করা যায়। অনুগ্রহ ও সদ্ব্যবহার দ্বারা তার শত্রুতা দূর করা যায়। যেমন পবিত্র কুরআনের ঐ আয়াতগুলির মধ্যে রয়েছে যেগুলি ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। অন্য জায়গায় আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেনঃ اِنَّ عِبَادِیْ لَیْسَ لَكَ عَلَیْهِمْ سُلْطٰنٌؕ وَ كَفٰى بِرَبِّكَ وَكِیْلًا 


অর্থাৎ “নিশ্চয় আমার বিশিষ্ট বান্দাদের উপর তোমার কর্তৃত্ব চলবে না, আল্লাহর প্রতিনিধিত্বই যথেষ্ট।' (১৭:৬৫) আল্লাহ পাক ইসলামের শত্রুদের মুকাবিলায় ফেরেশতা পাঠিয়েছেন এবং তাদের গর্ব খর্ব করেছেন। এটাও স্মরণীয় বিষয় যে, যে মুসলিম কাফিরের হাতে মৃত্যুবরণ করেন, তিনি শহীদ হন। যে সেই গোপনীয় শত্রু শয়তানের হাতে মারা পড়ে সে আল্লাহর দরবার থেকে হবে বহিষ্কৃত, বিতাড়িত। মুসলমানের উপর কাফিরেরা জয়যুক্ত হলে মুসলমান প্রতিদান পেয়ে থাকেন। কিন্তু যার উপর শয়তান জয়যুক্ত হয় সে ধ্বংস হয়ে যায়। শয়তান মানুষকে দেখতে পায় কিন্তু মানুষ শয়তানকে দেখতে পায় বলে কুরআন কারীমের শিক্ষা হলোঃ “তোমরা তার অনিষ্ট হতে তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর যিনি তাকে (শয়তানকে) দেখতে পান কিন্তু সে তাঁকে দেখতে পায় না।


আউযুবিল্লাহ পড়া হলো আল্লাহ তা'আলার নিকট বিনীত হয়ে প্রার্থনা করা এবং প্রত্যেক অনিষ্টকারীর অনিষ্ট হতে তার নিকট আশ্রয় চাওয়া। عَيَاذُه-এর অর্থ হলো অনিষ্ট দূর করা, আর لَيَاذُه-এর অর্থ হলো মঙ্গল ও কল্যাণ লাভ করা। এর প্রমাণ হিসেবে মুতানাব্বির এই কবিতাটি দ্রষ্টব্যঃ يَامَنْ اَلُوْذُ بِهٖ فِيْمَا اَوُمِّلُهٗ ـ وَمَنْ اَعُوْذُ بِهٖ مِمَّا اُحَاذِرُهٗ ـ لَايُجْبَرُ النَّاسُ عَظْمًا اَنْتَ كَاسِرُهٗ ـ وَلَايَهِيْضُوْنَ عَظْمًا اَنْتَجَابِرُهٗ অর্থাৎ ‘হে সেই পরিত্র সত্তা, যে সত্তার সাথে সাথে আমার সমুদয় আশা ভরসা বিজড়িত হয়েছে, এবং হে সেই পালনকর্তা যাঁর নিকট আমি সমস্ত অমঙ্গল থেকে আশ্রয় চাচ্ছি। যা তিনি ভেঙ্গে দেন তা কেউ জোড়া দিতে পারে এবং যা তিনি জোড়া দেন তা কেউ ভাঙ্গতে পারে না। اَعُوْذُ-এর অর্থ হলো এই যে, আমি আল্লাহ তা'আলার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি যেন বিতাড়িত শয়তান ইহজগতে ও পরজগতে আমার কোন ক্ষতি করতে না পারে। যে নির্দেশাবলী পালনের জন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি তা পালনে যেন আমি বিরত না হয়ে পড়ি। আবার যা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে তা যেন আমি করে না ফেলি। এটা তো বলাই বহুল্য যে, শয়তানের অনিষ্ট হতে একমাত্র আল্লাহ পাক ছাড়া আর কেউ রক্ষা করতে পারে না। এ জন্যে বিশ্ব প্রভু আল্লাহ মানুষরূপী শয়তানের দুষ্কার্য ও অন্যায় হতে নিরাপত্তা লাভ করার যে পন্থা শেখালেন তা হলো তাদের সঙ্গে সদাচরণ। কিন্তু জ্বিন রূপী শয়তানের দুষ্টুমি ও দুষ্কৃতি হতে রক্ষা পাওয়ার যে উপায় তিনি বলে দিলেন তা হলো তার স্বরণে আশ্রয় প্রার্থনা। কেননা, না তাকে ঘুষ দেওয়া যায়, না তার সাথে সদ্ব্যবহারের ফলে সে দুষ্টুমি হতে বিরত হয়। তার অনিষ্ট হতে তো বাঁচাতে পারেন একমাত্র আল্লাহ রাব্দুল ইযত। প্রাথমিক তিনটি আয়াতে এ বিষয় আলোচিত হয়েছে। সূরা-ই আরাফে আছেঃ خُذِ الْعَفْوَ وَ اْمُرْ بِالْعُرْفِ وَ اَعْرِضْ عَنِ الْجٰهِلِیْنَ (৭:১৯৯)। সূরা-ই-হা-মীম সেজদায় আছেঃ وَ لَا تَسْتَوِی الْحَسَنَةُ وَ لَا السَّیِّئَةُؕ-اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ (৪১:৩৪) এবং সূরা-ই মুমেনূনে রয়েছেঃ اِدْفَعْ بِالَّتِیْ هِیَ اَحْسَنُ السَّیِّئَةَؕ-نَحْنُ اَعْلَمُ بِمَا یَصِفُوْنَ (২৩:৯৬) 


এই তিনটি আয়াতের বিস্তারিত বর্ণনা ও অনুবাদ ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। সুতরাং পুনরাবৃত্তির আর তেমন প্রয়োজন নেই।


 شَيْطَان শয়তান -শব্দটির আভিধানিক বিশ্লেষণ


আরবী ভাষার অভিধানে شَيْطَان শব্দটি شَطَنٌ থেকে উদগত। এর আভিধানিক অর্থ হলো দূরত্ব। যেহেতু এই মারদুদ ও অভিশপ্ত শয়তান প্রকৃতগতভাবে মানব প্রকৃতি হতে দূরে রয়েছে, বরং নিজের দুষ্কৃতির কারণে প্রত্যেক মঙ্গল ও কল্যাণ হতে দূরে আছে, তাই তাকে শয়তান বলা হয়। একথাও বলা হয়েছে যে, এটা شَاطَ হতে গঠিত হয়েছে। কেননা সে আগুন হতে সৃষ্টি হয়েছে এবং شَاطَ এর অর্থ এটাই। কেউ কেউ বলেন যে, অর্থের দিক দিয়ে দুটোই ঠিক। কিন্তু প্রথমটিই বিশুদ্ধতর। আরব কবিদের কবিতার মধ্যে এর সত্যতা প্রমাণিত হয় সর্বোতভাবে। প্রসঙ্গক্রমে কবি উমাইয়া বিন আবিসসালাতের কবিতাটি এইঃ اَيُّمَا شَاطِنٌ عَصَاهٗ عَكَاهٗ ـ ثُمَّ يُلْقِىْ فِى السِّجْنِ وَالْاَغْلَالُ অনুরূপভাবে কবি নাবেগার কবিতার মধ্যেও এ শব্দটি شطن হতে গঠিত হয়েছে এবং দূর হওয়ার অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কবি নাবেগার কবিতাটি এইঃ نَاْتِ بِسُعَادِ عَنْكَ نَوٰى شُطُوْنٌ ـ فَبَاتِتْ وَالْفُوَادُ بِهَا رَهِيْنٌ সীবাওয়াইর উক্তি আছে যে, যখন কেউ শয়তানী কাজ করে তখন আরবেরা বলেঃ تَشَيْطَنَ فُلَانٌ কিন্তু تَشَيَّطَ فُلَانٌ  বলে না। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ শব্দটি شَاطَ  হতে নয়, বরং شَطَنٌ  হতেই নেয়া হয়েছে। এর সঠিক অর্থ হচ্ছে দূরত্ব। কোন জ্বিন, মানুষ বা চতুষ্পদ জন্তু দুষ্টুমি করলে তাকে শয়তান বলা হয়। কুরআন পাকে রয়েছেঃ وَ كَذٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِیٍّ عَدُوًّا شَیٰطِیْنَ الْاِنْسِ وَ الْجِنِّ یُوْحِیْ بَعْضُهُمْ اِلٰى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُوْرًاؕ 


অর্থাৎ এভাবেই আমি মানব ও দানব শয়তানদেরকে প্রত্যেক নবীর শত্রু করেছি যারা একে অপরের নিকট প্রতারণামূলক বানানো কথা পৌছিয়ে থাকে। মুসনাদ-ই-আহমাদে হযরত আবু যর (রাঃ) হতে একটি হাদীস বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) আমাকে বলেনঃ “হে আবূ যর (রাঃ)! দানব ও মানব শয়তানগণ হতে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। আমি বলি, মানুষের মধ্যেও কি শয়তান আছে? তিনি বলেনঃ হাঁ। সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত আবু যর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ স্ত্রীলোক, গাধা এবং কালো কুকুর নামায ভেঙ্গে নষ্ট করে দেয়। তিনি বলেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল (সঃ)! লাল, হলদে কুকুর হতে কালো কুকুরকে স্বতন্ত্র করার কারণ ছিল রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেনঃ কালো কুকুর শয়তান।


হযরত যায়েদ বিন আসলাম (রঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি তার পিতা হতে বর্ণনা করেনঃ হযরত উমার (রাঃ) একবার তকী ঘোড়ার উপরে আরোহণ করেন। ঘোড়াটির সগর্বে চলতে থাকে। হযরত উমার ঘোড়াটিকে মারপিটও করতে থাকেন। কিন্তু ওর সদর্প চাল আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি নেমে পড়েন এবং বলেনঃ তুমি তো আমার আরোহণের জন্যে কোন শয়তানকে ধরে এনেছ! আমার মনে অহংকারের ভাব এসে গেছে। সুতরাং আমি নেমে পড়াই ভাল মনে করলাম।' رَجِيْم শব্দটি - فَعِيْل এর ওজনে اِسْم مَفْعُوْل-এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ সে মারদুদ বা বিতাড়িত। অর্থাৎ প্রত্যেক মঙ্গল হতে সে দূরে আছে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেছেনঃ وَ لَقَدْ زَیَّنَّا السَّمَآءَ الدُّنْیَا بِمَصَابِیْحَ وَ جَعَلْنٰهَا رُجُوْمًا لِّلشَّیٰطِیْنِ 


অবশ্যই আমি দুনিয়ার আকাশকে তারকারাজি দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং ওগুলোকে শয়তানদের তাড়ন করেছি। তারা বড় বড় ফেরেশতাদের কথা শুনতে পায় না এবং তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য চতুর্দিক হতে মারা হয়, আর তাদের জন্যে চিরস্থায়ী শাস্তি রয়েছে। তাদের মধ্য হতে কেউ কোন কথা ছোঁ মেরে নিয়ে পালালে একটা উজ্জ্বল অগ্নিশিখা তার পিছনে ধাওয়া করে। অন্য জায়গায় ইরশাদ হচ্ছেঃ وَ لَقَدْ جَعَلْنَا فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ زَیَّنّٰهَا لِلنّٰظِرِیْنَ ـ وَ حَفِظْنٰهَا مِنْ كُلِّ شَیْطٰنٍ رَّجِیْمٍ ـ اِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ السَّمْعَ فَاَتْبَعَهٗ شِهَابٌ مُّبِیْنٌ


অর্থাৎ ‘আকাশে আমি স্তম্ভ তৈরী করেছি এবং দর্শকদের জন্যে একে প্রত্যেক বিতাড়িত শয়তান হতে নিরাপদ করেছি। কিন্তু কেউ কোন কথা চুরি করে নিয়ে যায় তখন একটা উজ্জ্বল আলোক শিখা তার পিছু ধাওয়া করে।' (১৫:১৬-১৮) এরকম আরও বহু আয়াত রয়েছে رَجِيْم এর একটা অর্থ رَجْمٌ ও করা হয়েছে। যেহেতু শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা এবং ভ্রান্তির দ্বারা রজম করে থাকে এ জন্যে তাকে ‘রাজীম' অর্থাৎ ‘রাজেম' বলা হয়। 


 অতীব মেহেরবান পরম করুণাময় আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। 


সকল সাহাবী (রাঃ) আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদকে বিসমিল্লাহর দ্বারাই আরম্ভ করেছেন। আলেমগণ এ বিষয়ে একমত যে, সূরা-ই-নামল'-এর এটা একটা আয়াত। তবে এটা প্রত্যেক সূরার প্রারম্ভে একটা পৃথক আয়াত কি-না, বা প্রত্যেক সূরার একটা আয়াতের অংশ বিশেষ কি-না, কিংবা এটা কি শুধুমাত্র সূরা-ই-ফাতিহারই আয়াত-অন্য সূরার নয়, কিংবা এক সূরাকে অন্য সূরা হতে পৃথক করার জন্যেই কি একে লিখা হয়েছে এবং এটা আয়াত নয়, এ সব বিষয়ে বেশ মতভেদ রয়েছে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী যুগের আলেমগণের মধ্যে এ ব্যাপারে মতবিরোধ চলে আসছে এবং আপন স্থানে এর বিস্তারিত বিবরণও রয়েছে। সুনান-ই-আবি দাউদে সহীহ সনদের সঙ্গে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) এই, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে এক সূরাকে অন্য সূরা হতে অনায়াসে পৃথক করতে পারতেন না। ‘মুসতাদরিক-ই-হাকিমের মধ্যেও এ হাদীসটি বর্ণিত আছে। একটা মুরসাল হাদীসে হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রাঃ) হতেও হাদীসটি রেওয়ায়িত করা হয়েছে। সহীহ ইবনে খুযাইমার মধ্যে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) “বিসমিল্লাহ'-কে সূরা-ই-ফাতিহার পূর্বে নামাযে পড়েছেন এবং তাকে একটা পৃথক আয়াতরূপে গণনা করেছেন। কিন্তু এ হাদীসের একজন বর্ণনাকারী উমার বিন হারূন বালখী উসূলে হাদীসের পরিভাষায় দুর্বল। এর অনুসরণে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতেও একটা হাদীস বর্ণিত হয়েছে এবং অনুরূপভাবে হযরত আলী (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ হতেও বর্ণিত আছে। হযরত আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রাঃ), হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হযরত আলী (রাঃ), হযরত আতা' (রঃ), হযরত তাউস (রঃ), হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), হযরত মাকহুল (রঃ) এবং হযরত যুহরীর (রঃ) এটাই নীতি ও অভিমত যে, ‘বিসমিল্লাহ' সূরা-ই-বারাআত' ছাড়া কুরআনের প্রত্যেক সূরারই একটা পৃথক আয়াত। এসব সাহাবী (রাঃ) ও তাবেঈ (রঃ) ছাড়াও হযরত আবদুল্লাহ বিন মুবারক (রঃ), ইমাম শাফিঈ (রঃ), ইমাম আহমাদের (রঃ) একটি কাওলে এবং ইসহাক বিন রাহওয়াহ (রঃ) ও আবু উবাইদ কাসিম বিন সালামেরও (রঃ) এটাই মাযহাব। তবে ইমাম মালিক (রঃ) এবং ইমাম আবু হানীফা (রঃ) ও তাঁদের সহচরগণ বলেন যে, ‘বিসমিল্লাহ' সূরা-ই-ফাতিহারও আয়াত নয় বা অন্য কোন সূরারও আয়াত নয়।


ইমাম শাফিঈর (রঃ) একটি কাওল এই যে, এটা সূরা-ই-ফাতিহার একটি আয়াত বটে কিন্তু অন্য কোন সূরার আয়াত নয়। তার একটা কাওল এও আছে যে, এটা প্রত্যেক সূরার প্রথম আয়াতের অংশ বিশেষ। কিন্তু হাদীসের পরিভাষায় এই দুই কাওল বা উক্তিই হচ্ছে গারীব। দাউদ (রঃ) বলেন যে, এটা প্রত্যেক সূরার প্রথমে একটা পৃথক আয়াত-সূরার অন্তর্ভুক্ত নয়। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রঃ) হতেও এটাই বর্ণিত আছে এবং আবু বকর রাযী, আবু হাসান কুরখীরও এ মাযহাবই বর্ণনা করেছেন। তিনি ইমাম আবু হানীফার (রঃ) একজন বড় মর্যাদাসম্পন্ন সহচর। এ হল বিসমিল্লাহর সূরা-ই-ফাতিহার আয়াত হওয়া না হওয়ার আলেচনা। এখন একে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে হবে না নিম্নস্বরে এ নিয়েও মতভেদের অবকাশ রয়েছে। যারা একে সূরা-ই-ফাতিহার পৃথক একটা আয়াত মনে করেন তারা একে নিম্নস্বরে পড়ার পক্ষপাতি। এখন অবশিষ্ট রইলেন শুধু ঐ সব লোক যাঁরা বলেন যে, এটা প্রত্যেক সূরার প্রথম। তাঁদের মধ্যেও আবার মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফিঈর (রঃ) মাযহাব এই যে, সূরাই-ফাতিহা ও প্রত্যেক সূরার পূর্বে একে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে হবে। সাহাবা (রাঃ), তাবেঈন (রঃ) এবং মুসলমানদের পূর্ববর্তী যুগের ইমামগণের এটাই মাযহাব। সাহাবীগণের (রাঃ) মধ্যে একে উচ্চৈঃস্বরে পড়ার পক্ষপাতি হলেন হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ), হযরত ইবনে উমার (রাঃ), হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত মুআবিয়া (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ), হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উসমান (রাঃ)। হযরত আবু বকর (রাঃ) এবং হযরত উসমান (রাঃ) হতেও গারীব বা দুর্বল সনদে ইমাম খতীব (রঃ) এটা নকল করেছেন। বায়হাকী (রঃ) ও ইবনে আবদুল বারী (রঃ) হযরত উমার (রাঃ) ও হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণনা করেছেন। তাবেঈগণের মধ্যে হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), হযরত ইকরামা (রঃ), হযরত আবু কালাবাহ (রঃ), হযরত যুহরী (রঃ), হযরত আলী বিন হাসান (রঃ), তাঁর ছেলে মুহাম্মদ সাঈদ বিন মুসাইয়াব (রঃ), আতা’ (রঃ), তাউস (রঃ), মুজাহিদ (রঃ), সা'লিম (রঃ), মুহাম্মদ বিন কা'ব কারজী (রঃ), উবাইদ (রঃ), আবূ বকর বিন মুহাম্মদ বিন আমর (রঃ), ইবনে হারাম আবূ ওয়ায়েল (রঃ), ইবনে সীরীন (রঃ), মুহাম্মদ বিন মুনকাদির (র), আলী বিন আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রঃ), তাঁর ছেলে মুহাম্মদ নাফি, ইবনে উমারের (রাঃ) গোলাম (রঃ), যায়েদ বিন আসলাম (রঃ), উমার বিন আবদুল আযীয (রঃ), আরযাক বিন কায়েস (রঃ), হাবীব বিন আবি সাবিত (রঃ), আবু শা’শা' (রঃ), মাকহুল (রঃ), আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল বিন মাকরান (রঃ), এবং বায়হাকীর বর্ণনায় আবদুল্লাহ বিন সাফওয়ান (রঃ), মুহাম্মদ বিন হানাফিয়্যাহ (রঃ) এবং আবদুল বারের বর্ণনায় আমর বিন দীনার (রঃ)। এরা সবাই নামাযের যেখানে কিরআত উচ্চৈঃস্বরে পড়া হয়, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকেও উচ্চ শব্দে পড়তেন। এর একটি প্রধান দলীল এই যে, এটা যখন সূরা ই ফাতিহারই একটা আয়াত তখন পূর্ণ সূরার ন্যায় একে উচ্চৈঃস্বরে পড়তে হবে। তাছাড়া সুনান-ই-নাসাঈ, সহীহ ইবনে খুযাইমা, সহীহ ইবনে হিব্বান, মুসতাদরিক-ই- হাকিম প্রভৃতি হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, হযরত আবু হুরাইরাহ (রাঃ) নামায পড়লেন এবং কিরাআতে উচ্চ শব্দে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম পড়লেন এবং নামায শেষে বললেনঃ “তোমাদের সবার চাইতে রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর নামাযের সঙ্গে আমার নামাযেরই সামঞ্জস্য বেশী। দারকুতনী, খাতীব এবং বায়হাকী প্রমুখ মুহাদ্দিসগণ এ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সুনান-ই-আবি দাউদ ও জামেউত তিরমিযীর মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' দ্বারা নামায আরম্ভ করতেন। ইমাম তিরমিযী (রঃ) বলেন যে, হাদীসটি খুব সঠিক নয়। মুসতাদরিক-ই-হাকিমের মধ্যে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকে ' উচ্চৈঃস্বরে পড়তেন। ইমাম হাকীম (রঃ) এ হাদীসকে সঠিক বলেছেন। সহীহ বুখারীতে আছে যে, হযরত আনাস (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়ঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর কিরাআত কিরূপ ছিল? তিনি বললেনঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক খাড়া শব্দকে লম্বা করে পড়তেন। অতঃপর তিনি بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পাঠ করে শুনালেন এবং বললেন بِسْمِ اللّٰهِ -কে মদ (লম্বা) করেছেন الرَّحْمٰنِ -এর উপর মদ করেছেন ও الرَّحِیْمِ-এর উপর মদ করেছেন। মুসনাদ-ই-আহমাদ, সুনান-ই-আবি দাউদ, সহীহ ইবনে খুযাইমা এবং মুসতাদরিক-ই-হাকিমে হযরত উম্মে সালমা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক আয়াত শেষে থামতেন এবং তাঁর কিরাআত পৃথক পৃথক হতো। যেমন بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ পড়ে থামতেন, তারপর اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ পড়তেন, পুনরায় থেমে مٰلِكِ یَوْمِ الدِّیْنِ পড়তেন। এইভাবে তিনি পড়তেন। দারাকুতনী (রঃ) এ হাদীসটিকে সঠিক বলেছেন। ইমাম শাফিঈ (রঃ) ও ইমাম হাকিম (রঃ) হয়রত আনাস (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন যে, হযরত মু'আবিয়া (রাঃ) মদীনায় নামায পড়ালেন এবং ‘বিসমিল্লাহ' পড়লেন না। সে সময় যেসব মুহাজির সাহাবী (রাঃ) উপস্থিত ছিলেন তাঁরা এতে আপত্তি জানালেন। সুতরাং তিনি পুনরায় যখন নামায পড়ানোর জন্য দাড়ালেন তখন ‘বিসমিল্লাহ' পাঠ করলেন। প্রায় নিশ্চিতরূপেই উল্লিখিত সংখ্যক হাদীস এ মাযহাবের দলীলের জন্যে যথেষ্ট। এখন বাকী থাকলে তাদের বিপক্ষের হাদীস, বর্ণনা, সনদ, দুর্বলতা ইত্যাদি। ওগুলোর জন্যে অন্য জায়গা রয়েছে।


দ্বিতীয় মাযহাব এই যে, ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে পড়তে হবে না। খলীফা চতুষ্টয়, আবদুল্লাহ বিন মুগাফফাল, তাবেঈন ও পরবর্তী যুগের দলসমূহ হতে এটা সাব্যস্ত আছে। আবূ হানীফা (রঃ), সাওরী (রঃ) এবং আহমদ বিন হাম্বলের (রঃ) এটাই মাযহাব। ইমাম মালিকের (রঃ) মাযহাব এই যে, ‘বিসমিল্লাহ' পড়তেই হবে না, জোরেও নয়, আস্তেও নয়। তাঁর প্রথম দলীল তো সহীহ মুসলিমের হযরত আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হাদীসটি যাতে রয়েছে যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) নামাযকে তাকবীর ও কিরাআতকে اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ দ্বারা শুরু করতেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে আছে যে, হযরত আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘আমি নবী (সঃ), হযরত আবু বকর (রাঃ), হযরত উমার (রাঃ) এবং হযরত উসমানের (রাঃ) পিছনে নামায পড়েছি। তারা সবাই اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ দ্বারা নামায আরম্ভ করতেন। সহীহ মুসলিমের মধ্যে আছে যে, বিসমিল্লাহ বলতেন না। কিরাআতের প্রথমেও না, শেষেও না। সুনানের মধ্যে হযরত মাগফাল (রাঃ) হতেও এরূপই বর্ণিত আছে। এ হলো ঐসব ইমামের ‘বিসমিল্লাহ' আস্তে পড়ার দলীল। এ প্রসঙ্গে এটাও স্মর্তব্য যে, এ কোন বড় রকমের মতভেদ নয়। প্রত্যেক দলই অন্য দলের নামাযকে শুদ্ধ বলে থাকেন।



বিসমিল্লাহ’র ফযীলতের বর্ণনা


তাফসীর-ই-ইবনে আবি হাতিমে রয়েছে যে, হযরত উসমান বিন আফফান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সঃ)কে ‘বিসমিল্লাহ' সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেনঃ “এ তো আল্লাহ তাআলার নাম। আল্লাহর বড় নাম এবং এই বিসমিল্লাহর মধ্যে এতদুর নৈকট্য রয়েছে যেমন রয়েছে চক্ষুর কালো অংশও সাদা অংশের মধ্যে।” ইবনে মরদুওয়াইর (রঃ) তাফসীরের মধ্যেও এরূপ একটি বর্ণনা রয়েছে। তাফসীর-ই-ইবনে মরদুওয়াই'-এর মধ্যে এ বর্ণনাটিও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ হযরত ঈসার (আঃ) আম্মা হযরত মরঈয়াম (আঃ) যখন তাঁকে মক্তবে নিয়ে গিয়ে শিক্ষকের সামনে বসালেন তখন তাকে বললেনঃ ‘বিসমিল্লাহ' লিখুন। হযরত ঈসা (আঃ) বললেনঃ ‘বিসমিল্লাহ কি?' শিক্ষক উত্তর দিলেনঃ আমি জানি না।' তিনি বললেনঃ ب -এর ভাবার্থ হলো بَهَاءُ اللّٰهِ অর্থাৎ আল্লাহর উচ্চতা।' س -এর ভাবার্থ হলো سَنَاءُهُ অর্থাৎ আল্লাহর আলোক। م -এর তাৎপর্য হলো مُمْلِكَتُهٗ বা আল্লাহর রাজত্ব। الله বলে উপাস্যদের উপাস্যকে। رَحْمٰن-বলে দুনিয়া ও আখেরাতের করুণাময় কৃপানিধানকে, এবং আখেরাতে যিনি দয়া প্রদর্শন করবেন তাকে رَحِيْم বলা হয়। তাফসীর-ই-ইবনে জারীরের মধ্যেও এ বর্ণনাটি রয়েছে। কিন্তু সনদের দিক দিয়ে তা খুবই গরীব বা দুর্বল। হতে পারে যে, এটি কোন সাহাবী (রাঃ) প্রমুখ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে কিংবা হতে পারে যে, বানী ইসরাঈলের বর্ণনাসমূহের মধ্যে এটা একটা বর্ণনা। এর মারফু হাদীস হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অবশ্য আল্লাহ পাকই এ ব্যাপারে সঠিক জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী। 


ইবনে মরদুওয়াই এর তাফসীরে রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ ‘আমার উপর এমন একটি আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে যার মত আয়াত হযরত সুলাইমান ছাড়া অন্য কোন নবীর উপর অবতীর্ণ হয়নি। আয়াতটি হলো ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম'।' হযরত জাবির (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, যখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয় তখন পূর্ব দিকে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, বায়ু মণ্ডলী স্তব্ধ হয়ে যায়, তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ সমুদ্র প্রশান্ত হয়ে উঠে, জন্তুগুলো কান লাগিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে, আকাশ থেকে অগ্নিশিখা নিক্ষিপ্ত হয়ে শয়তানকে বিতাড়ন করে এবং বিশ্বপ্রভু স্বীয় সম্মান ও মর্যাদার কসম করে বলেনঃ “যে জিনিসের উপর আমার এ নাম নেওয়া যাবে তাতে অবশ্যই বরকত হবে। হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, দোযখের ১৯টি দারোগার হাত হতে যে বাঁচতে চায় সে যেন ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম' পাঠ করে। এতেও ঘটেছে ১৯টি অক্ষরের সমাবেশ। প্রত্যেকটি অক্ষর প্রত্যেক ফেরেশতার জন্যে রক্ষক হিসেবে কাজ করবে। কুরতবীর সমর্থনে ইবনে আতিয়াহ্ এটা বর্ণনা করেছেন এবং এর পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি আরও একটি হাদীস এনেছেন। তাতে রয়েছেঃ “আমি স্বচক্ষে ত্রিশের বেশী ফেরেশতা দেখেছি যারা এটা নিয়ে তাড়াহুড়া করছিলেন। এটা রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেই সময় বলেছিলেন যখন একটি লোক رَبَّنَا لَكَ الْحَمْدُ حَمْدًا كَثِيْرًا طَيِّبًا مُبَارَكًا فِيْهِ পাঠ করেছিলেন। এর মধ্যে ত্রিশের বেশী অক্ষর রয়েছে। তৎসংখ্যক ফেরেশতাও অবতীর্ণ হয়েছিলেন। এ রকমই বিসমিল্লাহ’র মধ্যে উনিশটি অক্ষর আছে এবং তথায় ফেরেশতার সংখ্যাও হবে উনিশ। মুসনাদ-ই-আহমাদের মধ্যে রয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর। সোয়ারীর উপর তার পিছনে যে সাহাবী (রাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন তাঁর বর্ণনাটি, এইঃ রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উষ্ট্ৰীটির কিছু পদস্খলন ঘটলে আমি বললাম যে শয়তানের সর্বনাশ হোক। তখন তিনি বললেনঃ এরূপ বলো না, এতে শয়তান গর্বভরে ফুলে উঠে। এবং মনে করে যে, যেন সেইই স্বীয় শক্তির বলে ফেলে দিয়েছে। তবে হাঁ, ‘বিসমিল্লাহ' বলাতে সে মাছির মত লাঞ্ছিত ও হৃগর্ব হয়ে পড়ে।' ইমাম নাসাঈ (রঃ) স্বীয় কিতাব ‘আমালুল ইয়াওমে ওয়াল লাইলাহ' এর মধ্যে এবং ইবনে মরদুওয়াই (রঃ) স্বীয় তাফসীরের মধ্যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সাহাবীর (রাঃ) নাম বলেছেন উসামা বিন উমায়ের (রাঃ)। আর তার মধ্যেই আছেঃ ‘বিসমিল্লাহ’ বল। এটা একমাত্র বিসমিল্লাহরই বরকত।' এ জন্যেই প্রত্যেক কাজ ও কথার প্রারম্ভে বিসমিল্লাহ বলা মুসতাহাব। খুৎবার শুরুতেও বিসমিল্লাহ বলা উচিত। হাদীসে আছে যে, বিসমিল্লাহর দ্বারা যে কাজ আরম্ভ করা না হয় তা কল্যাণহীন ও বরকতশূন্য থাকে। পায়খানায় যাওয়ার সময়ও বিসমিল্লাহ বলবে। মুসনাদ-ই- আহমাদ এবং সুনানের মধ্যে রয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ), হযরত সাঈদ বিন যায়েদ (রাঃ) এবং হযরত আবু সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি ওজুর সময় বিসমিল্লাহ বলে না তার অর্য হয় না। এ হাদীসটি হাসান বা উত্তম। কোন কোন আলেম তো অযুর সময় বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব বলে থাকেন। প্রাণী যবাই করার সময়েও বিসমিল্লাহ বলা মুসতাহাব। ইমাম শাফিঈ (রঃ) এবং একটি দলের ধারণা এটাই। কেউ কেউ যিকিরের সময় এবং কেউ কেউ সাধারণভাবে একে ওয়াজিব বলে থাকেন। এর বিশদ বর্ণনা ইনশাআল্লাহ আবার অতি সত্বরই আসবে।


ইমাম ফাখরুদ্দনি রাযী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে এই আয়াতটির ফযীলত সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণনা করেছেন। একটি বর্ণনায় আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “যদি তুমি তোমার স্ত্রীর নিকট গিয়ে সহমিলনের প্রাক্কালে বিসমিল্লাহ পড়ে নাও আর তাতেই যদি আল্লাহ কোন সন্তান দান করেন, তাহলে তার নিজের ও তার সমস্ত ঔরসজাত সন্তানের নিঃশ্বাসের সংখ্যার সমান পূণ্য তোমার আমলনামায় লিখা হবে। কিন্তু এ বর্ণনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমি এটা কোথাও পাইনি। খাওয়ার সময়েও বিসমিল্লাহ পড়া মুসতাহাব। সহীহ মুসলিমে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত উমার বিন আবু সালামাকে (রঃ) যিনি তাঁর সহধর্মিনী হযরত উম্মে সালমার (রাঃ) পূর্ব স্বামীর পুত্র ছিলেন, বলেনঃ ‘বিসমিল্লাহ বল, ডান হাতে, খাও এবং তোমার সামনের দিক থেকে খেতে থাক।' কোন কোন আলেম এ সময়েও বিসমিল্লাহ বলা ওয়াজিব বলে থাকেন। স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের সময়েও বিসমিল্লাহ বলা উচিত। সহীহ বুখারী ও মুসলিমের মধ্যে হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমাদের মধ্যে কেউ স্বীয় স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের ইচ্ছে করলে যেন সে এটা পাঠ করেঃ بِسْمِ اللهِ اَللّٰهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا অর্থাৎ আল্লাহর নামের সঙ্গে আরম্ভ করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে এবং যা আমাদেরকে দান করবেন তাকেও শয়তানের কবল হতে রক্ষা করুন।


তিনি আরও বলেন যে, এই মিলনের ফলে যদি সে গর্ভধারণ করে তবে শয়তান সেই সন্তানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এখান হতে এটাও জানা গেল যে, বিসমিল্লাহর, ب এর সম্পর্ক কার সঙ্গে রয়েছে।


 ব্যাকরণগত শব্দ বিন্যাসঃ 


ব্যাকরণবিদগণের এতে দু’টি মত রয়েছে। দুটোই কাছাকাছি। কেউ একে اِسْم বলেন আবার কেউ فِعْل বলেন। প্রত্যেকেরই দলীল প্রমাণ কুরআন থেকে পাওয়া যায়। যারা একে اِسْم-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে থাকেন তাঁরা বলেনঃ بِسْمِ اللّٰهِ اِبْتِدَائِىْ 


অর্থাৎ আমার আরম্ভ আল্লাহর নামের সঙ্গে। কুরআন পাকে রয়েছেঃ (১১:৪১) وَ قَالَ ارْكَبُوْا فِیْهَا بِسْمِ اللّٰهِ مَجْرٖؔىهَا وَ مُرْسٰىهَاؕ-اِنَّ رَبِّیْ لَغَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ এ আয়াতে اِسْم অর্থাৎ مَصْدَر প্রকাশ করে দেয়া হয়েছে। আর যারা একে فِعْل-এর সঙ্গে উহ্য বলে থাকেন সে اَمْر ـ فِعْل ই হোক বা خَبْر ই হোক, যেমন اِيْدَا بِسْمِ اللّٰهِ এবং بَدَاْتُ بِسْمِ اللّٰهِ তাদের দলীল হচ্ছে কুরআন কারীমের এই নিরূপ আয়াতটিঃ اِقْرَاْ بِسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ প্রকৃতপক্ষে দুটোই সঠিক ও শুদ্ধ। কেননা, فِعْل এর জন্যেও مَصْدَر হওয়া জরুরী। তাহলে এটা ইচ্ছাধীন রয়েছে যে, فِعْل কে উহ্য মনে করা হোক এবং ওর مَصْدَر কে সেই فِعْل অনুসারে দাঁড় করানো হোক যার নাম পূর্বে নেয়া হয়েছে। দাঁড়ান হোক, বসা হোক, খানাপিনা হোক, কুরআন পাঠ হোক বা অযু ও নামায ইত্যাদি হোক, এসবের প্রথমে বরকত লাভের উদ্দেশ্যে সাহায্য চাওয়ার জন্যে এবং প্রার্থনা মঞ্জুরীর জন্যে আল্লাহর নাম নেয়া ইসলামী শরীয়তের একটি বিধান। আল্লাহই এ সম্পর্কে সবচাইতে ভাল জানেন। ইবনে জারীর এবং ইবনে আবি হাতিমের তাফসীর ও মুসনাদে রয়েছে, হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, সর্বপ্রথম যখন হযরত জিব্রাঈল (আঃ) হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর নিকট ওয়াহী নিয়ে আসেন তখন বলেনঃ হে মুহাম্মদ (সঃ)! বলুন– اَسْتَعِيْذُ بِاللهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ আবার বলুনঃ بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ


উদ্দেশ্য ছিল যেন উঠা, বসা, পড়া, খাওয়া সব কিছুই আল্লাহর নামে আরম্ভ হয়।


 اِسْمٌ ইসম শব্দটির তাহকীকঃ 


اِسْمٌ অর্থাৎ নামটাই কি ‘মুসাম্মা’ অর্থাৎ নামযুক্ত না অন্য কিছু? এ ব্যাপারে তিন দল আলিমের তিন রকম উক্তি রয়েছে। প্রথম এই যে, নামটাই হচ্ছে মুসাম্মা বা নামযুক্ত। আবু উবাইদাহ এবং সিবওয়াইয়ের কথা এটাই। বাকিল্লানী এবং ইবনে ফুরকও এটাই পছন্দ করেন। মুহাম্মদ ইবনে উমর ইবনে খাতীব রাজী স্বীয় তাফসীরের সূচনায় লিখেছেনঃ “হাসভিয়্যাহ কারামিয়্যাহ এবং আশরিয়্যাহগণ বলেন যে, اِسْم হলো نَفْسِ مُسَمّٰى কিন্তু نَفْسِ تَسْمِيَّة হতে পৃথক এবং মুতাযিলারা বলেন যে, اِسْم হলো نَفْسِ تَسْمِيَّة কিন্তু نَفْسِ مُسَمّٰى হতে আলাদা। আমাদের মতে اِسْم টা  مُسَمّٰى ও غَيْرِمُسَمّٰى দু'টো থেকেই আলাদা। আমরা বলি যে, যদি اِسْم-এর উদ্দেশ্যে لَفْظ হয় যা শব্দসমূহের অংশ বা অক্ষরসমূহের সমষ্টি, তবে তো এটা অবশ্যম্ভাবীরূপে সাব্যস্ত হয় যে, এটা مُسَمّٰى হতে পৃথক। আর যদি اِسْم হতে উদ্দেশ্য হয় ذَاتِ مُسَمّٰى তবে তো এ একটা স্পষ্টকে স্পষ্ট করার কাজ যা শুধু নিরর্থক ও বাজে কাজেরই নামান্তর। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট কথা যে, বাজে আলোচনায় সময়ের অপচয় একটা নিছক অনর্থক কাজ। অতঃপর اِسْم ও مُسَمّٰى কে পৃথকীকরণের উপর দলীল প্রমাণ আনা হয়েছে যে, কখনও اِسْم হয় কিন্তু مُسَمّٰى মোটেই হয় না। যেমন مَعْدُوْم বা অস্তিত্বহীন শব্দটি। কখনও আবার একটি مُسَمّٰى কয়েকটি اِسْم হয়। যেমন مُتَرَادِفُ বা একার্থবোধক শব্দ। আবার কখনও اِسْم একটি হয় এবং مُسَمّٰى হয় কয়েকটি। যেমন مُشْتَرِك, সুতরাং বুঝা গেল যে, اِسْم ও مُسَمّٰى এক জিনিস নয়। অর্থাৎ নাম এক জিনিস এবং ‘মুসাম্মা’ বা নামধারী অন্য জিনিস। কারণ যদি اِسْم কেই مُسَمّٰى ধরা হয় তবে আগুনের নাম নেয়া মাত্রই তার দাহন ও গরম অনুভূত হওয়া উচিত এবং বরফের নাম নিলেই ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়া। দরকার। অথচ কোন জ্ঞানীই একথা বলেন না-বলতে পারেন না। এর দলীল প্রমাণ এই যে, আল্লাহ তা'আলার নির্দেশ রয়েছেঃ وَلِلّٰهِ الْاَسْمَاءُ الْحُسْنٰى فَادْعُوْهُ بِهَا 


অর্থাৎ আল্লাহর অনেক উত্তম নাম রয়েছে, তোমরা ঐসব নাম দ্বারা আল্লাহকে ডাকতে থাক। হাদীস শরীফে আছে যে, আল্লাহ তা'আলার ৯৯টা নাম আছে। তাহলে চিন্তার বিষয় যে, নাম কত বেশী আছে। অথচ مُسَمّٰى একটিই এবং তিনি হলেন অংশীবিহীন এক অদ্বিতীয় আল্লাহ। এরকমই اَسْمَاءُ  কে এ আয়াতে اَلله-এর দিকে সম্বন্ধ লাগান হয়েছে। আল্লাহ তা'আলা অন্য জায়গায় বলেছেনঃ فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيْمِ ইত্যাদি। اِضَافَت-ও এটাই চায় যে, اِسْم ও مُسَمّٰى  অর্থাৎ নাম ও নামধারী আলাদা জিনিস। কারণ اِضَافَت দ্বারা সম্পূর্ণ অন্য এক বিরোধী বস্তুকে বুঝায়। এরকমই আল্লাহ তা'আলার উপরোক্ত নির্দেশঃ فَادْعُوْهُ بِهَا 


অর্থাৎ আল্লাহ তাআলাকে তাঁর নামসমূহ দ্বারাই ডাক। এটাও এ বিষয়ের দলীল প্রমাণ যে, নাম এক জিনিস এবং নামধারী আলাদা জিনিস। এখন যারা اِسْم ও مُسَمّٰى কে এক বলেন তাদের দলীল এই যে, আল্লাহ তা'আলা বলেনঃ تَبٰرَكَ اسْمُ رَبِّكَ ذِی الْجَلٰلِ وَ الْاِكْرَامِ অর্থাৎ তোমার মহান প্রভুর অতি সম্মান ও মর্যাদাসম্পন্ন কল্যাণময় নাম রয়েছে।' (৫৫:৭৮) নামকে কল্যাণময় ও মর্যাদাসম্পন্ন বলা হয়েছে, অথচ স্বয়ং আল্লাহই কল্যাণময়। এর সহজ উত্তর এই যে, সেই পবিত্র প্রভুর কারণেই তাঁর নামও শ্রেষ্ঠত্বপূর্ণ হয়েছে। তাদের দ্বিতীয় দলীল এই যে, যখন কোন ব্যক্তি বলেঃ যয়নাবের উপর তালাক’, তখন তালাক শুধু সেই ব্যক্তির ঐ স্ত্রীর উপর হয়ে থাকে যার নাম যয়নাব। যদি নাম ও নামধারীর মধ্যে পার্থক্য থাকতো তবে শুধু নামের উপরই তালাক পড়তো, নামধারীর উপর কি করে পড়তো? এর উত্তর এই যে, এ কথার ভাবার্থ হয় এইরূপঃ যার নাম যয়নাব তার উপর তালাক। تَسْمِيَّة এর اِسْم  হতে আলাদা হওয়া এই দলীলের উপর ভিত্তি করে যে, تَسْمِيَّة বলা হয় কারও নাম নির্ধারণ করাকে। আর এটা সুস্পষ্ট কথা যে, এটা এক জিনিস এবং নামধারী অন্য জিনিস। ইমাম রাযীর (রঃ) কথা এটাই। এ সবকিছু بِاسْم-এর সম্পর্কে আলোচনা ছিল। এখন اَللّٰه শব্দ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হচ্ছে।


 اَلله আল্লাহ শব্দটির তাহকীকঃ 


اَللهُ বরকত বিশিষ্ট ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন মহান প্রভুর একটি বিশিষ্ট নাম। বলা হয় যে, এটাই اِسْمِ اَعْظَم কেননা, সমুদয় উত্তম গুণের সঙ্গে এটাই গুণান্বিত হয়ে থাকে। যেমন পবিত্র কুরআনে রয়েছেঃ هُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ-عٰلِمُ الْغَیْبِ وَ الشَّهَادَةِۚ-هُوَ الرَّحْمٰنُ الرَّحِیْمُ ـهُوَ اللّٰهُ الَّذِیْ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَۚ-اَلْمَلِكُ الْقُدُّوْسُ السَّلٰمُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَیْمِنُ الْعَزِیْزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُؕ-سُبْحٰنَ اللّٰهِ عَمَّا یُشْرِكُوْنَ ـهُوَ اللّٰهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰىؕ-یُسَبِّحُ لَهٗ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِۚ-وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ অর্থাৎ তিনিই সেই আল্লাহ যিনি ছাড়া অন্য কেউ উপাস্য নেই, তিনি প্রকাশ্য ও অদৃশ্য বস্তুসমূহের জ্ঞাতা, তিনি বড়ই মেহেরবান, পরম দয়ালু। তিনি এমন উপাস্য যে, তিনি ছাড়া আর কেউ উপাস্য নেই, তিনি বাদশাহ, পবিত্র, নিরাপত্তা প্রদানকারী, আশ্রয়দাতা, রক্ষাকর্তা, প্রবল মহাপরাক্রম গর্বের অধিকারী, সুমহান। আল্লাহ তাআলা মানুষের অংশীবাদ হতে পবিত্র। তিনি সষ্টিকারী, উদ্ভাবন কর্তা, রূপশিল্পী তাঁরই জন্য উত্তম উত্তম নামসমূহ রয়েছে, তিনি মহান পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।' (৫৯:২২-২৪) এ আয়াতসমূহে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সবগুলোই গুণবাচক নাম এবং ওগুলো ‘আল্লাহ’ শব্দেরই বিশেষণ। সুতরাং মূল ও প্রকৃত নাম ‘আল্লাহ’। যেমন আল্লাহ পাক বলেছেনঃ وَلِلهِ الْاَسْمَاءُ الْحُسْنٰى فَدْعُوْهُ بِهَا অর্থাৎ আল্লাহর জন্যে পবিত্র ও উত্তম নাম রয়েছে, সুতরাং তোমরা তাঁকে ঐসব নাম ধরে ডাক।


সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ আল্লাহ তা'আলার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে। এক শতের একটা কম। যে ওগুলো গণনা করবে সে বেহেশতে প্রবেশ করবে। 'জামেউত তিরমিযী ও সুনান-ই-ইবনে মাজার বর্ণনায় এ নামগুলোর ব্যাখ্যাও এসেছে। ঐ দুই হাদীস গ্রন্থের বর্ণনায় শব্দের কিছু পার্থক্য আছে এবং সংখ্যায় কিছু কম-বেশী রয়েছে। ইমাম রাযী (রঃ) স্বীয় তাফসীরে কোন কোন লোক হতে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর পাঁচ হাজার নাম আছে। এক হাজার নাম তো কুরআন মাজীদ ও হাদীসে রয়েছে, এক হাজার আছে তাওরাতে, এক হাজার আছে ইঞ্জিলে, এক হাজার আছে যাবুরে এবং এক হাজার আছে লাওহে মাহফুযে'। ‘আল্লাহ’ এমন একটি নাম যা একমাত্র আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তা'আলা ছাড়া আর কারও নেই। এ কারণেই এর মূল উত্স কি তা আরবদের নিকটেও অজানা রয়েছে। এমনকি بَاب এর ও তাদের জানা নেই। বরং ব্যাকরণবিদগণের একটি বড় দলের ধারণা যে, এটা اِسْم جَامِد অর্থাৎ এটা কোন কিছু হতে বের হয়নি এবং এটা হতেও অন্য কিছু বের হয়নি। কুরতুবি (রঃ) উলামা-ই-কিরামের একটি বিরাট দলের পক্ষ থেকে এই নীতিটি নকল করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম শাফেঈ (রঃ), ইমাম খাত্তাবী (রঃ), ইমামুল হারামাইন (রঃ), ইমাম গাযযালী (রঃ) প্রমুখ বিদগ্ধ মনীষীগণ। খলীল (রঃ) এবং সিবওয়াইহ্ (রঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, اَلِف لَام এতে আবশ্যকীয়। ইমাম খাত্তাবী (রঃ)-এর প্রমাণরূপে বলেছেন যে, يَاالله তো বলা হয়ে থাকে কিন্তু يَارَحْمٰن বলতে শুনা যায় না। যদি اَلله শব্দের اَلِف لَام মূল শব্দের অন্তর্ভুক্ত হতো তবে আহ্বান সূচক শব্দ يَا ব্যবহৃত হতো না। কেননা, আরবী ব্যাকরণ অনুসারে اَلِف لَام বিশিষ্ট اِسْم-এর পূর্বে আহ্বান সূচক শব্দের ব্যবহার বৈধ নয়। কোন কোন বিদ্বান লোকের এ অভিমতও রয়েছে যে, এ শব্দটি মূল উৎস বিশিষ্ট। তারা এর দলীলরূপে রূবা ইবনু আজ্জাজের একটি কবিতা পেশ করেন। কবিতাটি নিম্নরূপঃ لِلهِ دَرُّ الْغَانِيَاتِ الْمُدَّةِ ـ سَبَحْنَ وَاسْتَرْجَعْنَ مِنْ تَاَلُّهِىْ এতে مَصْدَر হিসেবে تَاَلُّهِىْ-এর বর্ণনায় আছে যার  مَاضِى ـ مَصْدَر ও مُضَارِع হয় اَلَهَ يَاْلَهُ اُلْهَةً وَتَاَلُّهًا যেমন হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে। যে, তিনি يَذَرُكَ وَاٰلِهَتَكَ পড়তেন। এর ভাবার্থ হলো ইবাদত। অর্থাৎ তার উপাসনা করা হয় এবং তিনি কারও উপাসনা করেন না। মুজাহিদ (রঃ) প্রমুখ মনীষীবৃন্দ বলেনঃ “আলোচ্য শব্দটি مُشْتَق বা অন্য শব্দ থেকে নির্গত হওয়ার অনুকূলে। কেউ কেউ وَهُوَ اللهُ فِى السَّمٰوٰتِ وَفِى الْاَرْضِ এই আয়াতকে দলীলরূপে এনেছেনঃ অনুরূপভাবে অন্য আয়াতেও আছেঃ وَ هُوَ الَّذِیْ فِی السَّمَآءِ اِلٰهٌ وَّ فِی الْاَرْضِ اِلٰهٌؕ অর্থাৎ 


‘আসমানে ও যমীনে তিনিই একমাত্র আল্লাহ।' (৪৩:৮৪)এবং তিনিই একমাত্র সত্ত্বা যিনি আকাশেও উপাস্য এবং পৃথিবীতেও উপাস্য। সিবওয়াইহ (রঃ) খলীল (রঃ) থেকে নকল করেছেন যে, اَللهُ মূলে ছিল اَلٰهٌ যেমন فَعَالٌ অতঃপর هَمْزَة-এর পরিবর্তে اَلِف لَام আনা হয়েছে। যেমন اَلنَّاسُ মূলে اُنَاسٌ ছিল। কেউ কেউ বলেন যে, اَللهُ মূলে لَاهٌ ছিল। সম্মানের জন্যে পূর্বে اَلِف لَام আনা হয়েছে। সিবওয়াইহের পছন্দনীয় মত এটাই। আরব কবিদের কবিতার মধ্যেও এ শব্দটি পাওয়া যায়। যেমনঃ لَاهَ ابْنُ عَمِّكَ لَااَفْضَلْتُ فِى حَسَبٍ ـ عَنِّى وَلَااَنْتَ دَيَانِىْ فَتُخْزُوْنِىْ 


কাসাই ও ফারা বলেন যে, এটা মূলে ছিল لَااِلٰهَ অতঃপর هَمْزَة কে লুপ্ত করে প্রথম لَام কে দ্বিতীয় لَام এ اِدْغَام  করা হয়েছে। لٰكِنَّا هُوَ اللهُ رَبِّىْ-এর মধ্যে لٰكِنَّ اَنَا শব্দদ্বয় لٰكِنْ হয়েছে। হাসানের (রঃ) কিরআতে لٰكِنَّ اَنَا  ই রয়েছে। এটা وَلَهٌ হতে নেয়া হয়েছে। এবং এর অর্থ হলো تَحَيَّرَ জ্ঞান লোপ পাওয়াকে وَلَهٌ বলে। আরবী ভাষায় رَجُلٌ وَالِهٌ এবং اِمْرَاَةٌ وُلْهٰى ও مَوْلُوْهَةٌ ঐ সময়ে বলা হয় যখন তাদেরকে বিয়াবান জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আল্লাহ ও তাঁর গুণাবলীর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে বলে সেই পবিত্র সত্ত্বাকে ‘আল্লাহ’ বলা হয়ে থাকে। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে দেখা যায় যে, এ শব্দটি মূলে وِلَاهٌ  ছিল وَاو টি هَمْزَة তে পরিবর্তিত হয়েছে। যেমন وِشَاحٌ শব্দকে اِشَاحٌ ও وِسَادَةٌ শব্দকে اِسَادَةٌ বলা হয়। 


ইমাম রাযীর (রঃ) মত এই যে, এই শব্দটি اَلَهْتُ اِلٰى فُلَانٍ হতে নেয়া হয়েছে এবং তা سَكَنْتُ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ আমি অমুক হতে অনাবিল শান্তি ও আরাম লাভ করেছি। কেননা, জ্ঞান ও বিবেকের শান্তি শুধু আল্লাহর যিকরেই রয়েছে এবং আত্মার প্রকৃত খুশী একমাত্র তারই পরিচয়ে রয়েছে। একমাত্র তিনিই হলেন পূর্ণাঙ্গ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ, তিনি ছাড়া অন্য কেউ এরূপ নয়। এ কারণেই তাকে ‘আল্লাহ’ বলা হয়। কুরআন মাজীদের মধ্যে রয়েছেঃ اَلَا بِذِكْرِ اللّٰهِ تَطْمَىٕنُّ الْقُلُوْبُ 


অর্থাৎ মুমিনদের অন্তর শুধুমাত্র আল্লাহর যিকরের দ্বারাই অনাবিল শান্তি লাভ করে থাকে। (১৩:২৮) এটাও একটা মত যে, শব্দটি لَاهَ يَلُوُهُ হতে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ হয় গুপ্ত হওয়া ও পর্দা করা। এও বলা হয়েছে যে, শব্দটি اَلَهَ الْفَصِيْل হতে গৃহীত হয়েছে। বান্দা যেহেতু বিনয়ের সাথে সদা তার দিকে ঝুঁকে থাকে এবং সর্বাবস্থায়ই তাঁরই কৃপা ও করুণার অঞ্চল ধরে থাকে, সেহেতু তাকে আল্লাহ বলা হয়। একটা মত এও আছে যে, আরবের লোকেরা اَلَهَ الرَّجُلُ يَاْلَهُ ঐ সময়ে বলে যখন কেউ কোন দৈব দুর্ঘটনার ফলে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অনন্য তাকে আশ্রয় দেয় ও রক্ষা করে। যেহেতু সমস্ত সৃষ্টজীবকে বিপদ হতে মুক্তিদাতা একমাত্র মহান আল্লাহ, তাই তাকে ‘আল্লাহ’ বলা হয়। যেমন কুরআন পাকে রয়েছেঃ هُوَ يُجِيْرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيْهِ অর্থাৎ তিনিই রক্ষা করেন ও আশ্রয় দেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে অন্য কাউকেও রক্ষা করা যায় না।' (২৩:৮৯) আর প্রকৃত অনুগ্রহকারী একমাত্র তিনিই। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেনঃ وَ مَا بِكُمْ مِّنْ نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللّٰهِ 


অর্থাৎ তোমাদের উপর যতগুলো দান রয়েছে সবই আল্লাহ প্রদত্ত। তিনিই আহার দাতা। (১৬:৫৩) সুতরাং তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেনঃ وَهُوَ يُطْعِمُ وَلَايُطْعَمُ অর্থাৎ তিনিই আহার্য দেন তাঁকে আহার্য দেয়া হয় না। (৬:১৪) তিনিই প্রত্যেক জিনিসের আবিষ্কারক। তাই তিনি বলেনঃ قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِنْدِ اللّٰهِ অর্থাৎ তুমি বল-আল্লাহর তরফ হতেই প্রত্যেক জিনিসের অস্তিত্ব লাভ হয়েছে।' (৪:৭৮) ইমাম রাযীর (রঃ) গৃহীত মাযহাব এই যে اَلله শব্দটি مُشْتَق নয়। খলীল (রঃ), সিবওয়াইহ (রঃ) এবং অধিকাংশ উসূলিয়ীন ও ফাকীহদের এটাই অভিমত। এর অনেক দলীল-প্রমাণও রয়েছে। এটি مُشْتَق হলে এর অর্থের মধ্যেও বহু একক শব্দও জড়িত থাকতো। অথচ এরূপ হয় না। আবার শব্দটিকে مَوْصُوْف বানানো হয় এবং এর অনেকগুলো صِفَت ও আসে। যেমন রহমান রাহীম’ ‘মালিক কদুস' ইত্যাদি। সুতরাং বুঝা গেল যে, এটা مُشْتَق নয়। কুরআন মাজীদের এক জায়গায় আছে عَزِيْزِ الْحَمِيْدِ اللهِ এখানে এটা عَطْف بَيَان হয়েছে। আলোচ্য শব্দটির مُشْتَق  না হওয়ার একটি দলীল প্রমাণ রূপে নিম্নের هَلْ تَعْلَمْ لَهٗ سَمِيًّا (১৯:৬৫) এই আয়াতটি বর্ণনা করা হয়। আল্লাহ তাআলাই এ ব্যাপারে সবচাইতে ভাল জানেন।


কোন কোন লোক একথাও বলেছেন যে, اَللهُ শব্দ আরবী নয় বরং (রঃ) ইরানী শব্দ। কিন্তু ইমাম রাযী (রঃ) একে দুর্বল বলেছেন এবং আসলেও এটা দুর্বল। ইমাম রাযী (রঃ) বলেন যে, মাখলুক' বা সৃষ্টজীব দুই প্রকার। এক প্রকার হলেন তারাই যারা আল্লাহর মারিফাতের সাগর সৈকতে পৌছে গেছেন। দ্বিতীয় প্রকার হলো ওরাই যারা তা হতে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং সে বিস্ময়ের অন্ধকারে এবং বন্ধুর কন্টকাকীর্ণ উপত্যকায় পড়ে রয়েছে এবং সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তি সে হারিয়ে ফেলে একেবারে নিঃস্ব ও রিক্তহস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি মারিফাতের ধারে কাছে পৌছে গেছে এবং আল্লাহর নূর ও ঔজ্জ্বল্যের বাগানে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে থেমে গেছে সে সেখানেই দিশেহারা ও হতভম্ব হয়ে রয়ে গেছে। মোট কথা কেউ পূর্ণভাবে আল্লাহর পরিচিতি লাভ করতে পারেনি। সুতরাং এখন সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় যে, সেই মহান সত্ত্বার নামই ‘আল্লাহ’। সমস্ত সৃষ্টজীব তারই মুখাপেক্ষী, তারই সামনে মস্তক অবনতকারী এবং তাঁকেই অনুসন্ধানকারী। আল্লামা খলীল বিন আহমাদ ফারাহদীর (রঃ) কথা অনুসারে ‘আল্লাহ’ শব্দের অর্থ অন্য উৎস থেকেও করা যেতে পারে। আরবের বাক পদ্ধতিতে প্রত্যেক উঁচু জিনিসকে لَاهَا বলা হয়, আর যেহেতু বিশ্ব প্রভু সবচেয়ে উঁচু ও বড় এ জন্য তাকেও আল্লাহ বলা হয়। 


আবার اَلْهٌ-এর অর্থ হলো ইবাদত করা এবং تَاَلُّهٌ-এর অর্থ হলো আদেশ পালন ও কুরবানী করণ আর আল্লাহরই ইবাদত করা হয় এবং তাঁরই নামে কুরবানী দেওয়া হয় বলে তাকেও আল্লাহ বলা হয়। হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) কিরাআতে আছে। وَيَذَرُكَ وَاٰلِهَتَكَ-এর মূল হচ্ছে ف ـ اَلْاِلٰهُ কালিমার স্থলে هَمْزَة এসে ওটা লুপ্ত হয়েছে, অতঃপর نَفْس كَلِمَة-এর لَام টি অতিরিক্ত لَام কে تَعْرِيْف-এর জন্য আনা হয়েছিল, তার সঙ্গে মিলে গেছে এবং দুই لَام এ اِدْغَام হয়েছে। ফলে تَشْدِيْد বিশিষ্ট একটা لَام রয়ে গেছে এবং সম্মানের জন্যে اَلله বলা হয়েছে। 


 اَلرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ আর রহমানির রাহিম  


اَلرَّحْمٰنِ الرَّحِیْمِ শব্দ দুটিকে رَحْمَت থেকে নেওয়া হয়েছে। অর্থের দিক দিয়ে দু’টোর মধ্যেই মুবালাগাহ' বা আধিক্য রয়েছে, তবে ‘রাহীমের চেয়ে রহমানের মধ্যে আধিক্য বেশী আছে। আল্লামা ইবনে জারীরের (রঃ) কথামত জানা যায় যে, এতে প্রায় সবাই একমত। পূর্ববর্তী যুগের সালফে সালেহীন বা কোন আলেমের তাফসীরের মাধ্যমেও এটা জানা যায়। হযরত ঈসা (আঃ) এই অর্থই নিয়েছেন, যা ইতিপূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে-তা এই যে, রাহমানের অর্থ হলো দুনিয়া ও আখেরাতে দয়া প্রদর্শনকারী এবং রাহীমের অর্থ শুধু আখেরাতে রহমকারী। কেউ কেউ বলেন যে, رَحْمٰن শব্দটি مُشْتَق নয়। কারণ যদি তা এ রকমই হত তবে مَرْحُوْم এর সঙ্গে মিলে যেতো। অথচ কুরআন পাকের মধ্যে وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا (৩৩:৪৩) এসেছে। মুরাদের বরাতে ইবনুল আমবারী (রঃ) বলেছেন যে, رَحْمٰن  হচ্ছে ইব্রানী নাম, আরবী নয়। আবু ইসহাক যাজ্জাজ ‘মা’আনিল কুরআন' নামক অনবদ্য পুস্তকে লিখেছেন যে, আহমাদ বিন ইয়াহ্ইয়ার মতানুসারে রাহীম আরবী শব্দ এবং রাহমান ইবরানী শব্দ। দুটিকে একত্রিত করা হয়েছে। কিন্তু আবু ইসহাক বলেন যে, এ কথাটি তেমন মনে ধরে না। এ শব্দটি مُشْتَق হওয়ার দলীলরূপে কুরতুবী (রঃ) বলেন যে, জামেউত তিরমিযীর সহীহ হাদীসে আছে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলার ঘোষণা রয়েছেঃ “আমি রাহমান, আমি রহমকে সৃষ্টি করেছি এবং স্বীয় নাম হতেও এ নামটি বের করেছি। যে একে সংযুক্ত করবে আমিও তাকে যুক্ত করবে এবং যে অকে কেটে দেবে আমিও তাকে কেটে দেব।' এখন প্রকাশ্য হাদীসের বিরোধিতা ও অস্বীকার করার কোন উপায় বা অবকাশ নেই। এখন রইলো কাফিরদের এ নামকে অস্বীকার করার কথাটা। এটা শুধু তাদের অজ্ঞতা, মূর্খতা ও বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। কুরতুবী (রঃ) বলেন যে, ‘রাহমান’ ও ‘রাহীমের একই অর্থ যেমন نَدْمَانٌ ও نَدِيْمٌ শব্দদ্বয়। আবু উবাইদারও (রঃ) একই মত। একটা মত এও আছে যে, فُعْلَانٌ শব্দটি فَعِيْلٌ-এর মত নয় فُعْلَانٌ শব্দের মধ্যে অবশ্যম্ভাবীরূপে مُبَالَغَة হয়ে থাকে। যেমন غَضْبَانٌ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যে খুবই রাগান্বিত এবং একেবারে অগ্নিশর্মা হয়। আর فَعِيْلٌ শুধু فَاعِل ও مَفْعُوْل এর জন্যই আসে যা مُبَالَغَة শূন্য থাকে। আবু আলী ফারসী বলেন যে, رَحْمٰن শব্দটি সাধারণ اِسْم যা সর্ব প্রকারের দয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং শুধু আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। আর ‘রাহীমের সম্পর্ক শুধু মুমিনদের সঙ্গে যেমন আল্লাহ পাক বলেন, وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا 


অর্থাৎ তিনি মুমিনদের প্রতি দয়ালু। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এই দুটি নামই করুণা ও দয়া বিশিষ্ট। একের মধ্যে অন্যের তুলনায় দয়া ও করুণা বেশী আছে। হযরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) এই বর্ণনায় اَرَقٌ শব্দটি রয়েছে। খাত্তাবী ও অন্যেরা এর অর্থ اَرْفَقُ করে থাকেন। যেমন হাদীসের মধ্যে আছেঃ “আল্লাহ তা'আলা رِفْقٌ বিশিষ্ট অর্থাৎ স্ত্র, বিনীয় ও দয়ালু। প্রত্যেক কাজে তিনি বিনয়, তা ও সরলতা পছন্দ করেন। তিনি ম্রতা ও সরলতার প্রতি এমন নিয়ামত বর্ষণ করেন যা কঠোরতার প্রতি করেন না।


ইবনুল মুবারক বলেন, 'রাহমান তাকেই বলে যার কাছে চাইলে তিনি দান করেন, আর রাহীম তাকে বলে যার কাছে না চাইলে তিনি রাগান্বিত হন। জামেউত তিরমিযীতে আছে যে, আল্লাহ তা'আলার নিকট যে ব্যক্তি চায় না তিনি তার প্রতি রাগান্বিত হন। কোন একজন কবির কবিতায় আছেঃ اَللّٰهُ يَغْضَبُ اِنْ تَرَكْتَ سُوَالَهٗ ـ وَبَنِىْ اٰدَمَ حِيْنَ يُسْئَلُ يَغْضَبُ অর্থাৎ তুমি আল্লাহর নিকট চাওয়া ছেড়ে দিলেই তিনি রাগান্বিত হন, অথচ বনী আদমের নিকট চাওয়া হলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকে। আযরামী বলেন যে, রাহমানের অর্থ হলো যিনি সমুদয় সৃষ্ট জীবের প্রতি করুণা বর্ষণকারী। আর রাহীমের অর্থ হলো যিনি মুমিনদের উপর দয়া বর্ষণকারী। যেমন কুরআন কারীমের নিম্নের দু'টি আয়াতের মধ্যে রয়েছেঃ اَلرَّحْمٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوٰى ، ثُمَّ اسْتَوٰى عَلَ الْعَرْشِ এখানে মহান আল্লাহ اِسْتَوٰى শব্দের সঙ্গে رَحْمٰن শব্দটির উল্লেখ করেছেন যাতে শব্দটি স্বীয় সাধারণ দয়া ও করুণার অর্থে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু মুমিনদের বর্ণন্যর সঙ্গে رَحِيْم শব্দটির উল্লেখ করেছেন, যেমন বলেছেন وَ كَانَ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَحِیْمًا সুতরাং জানা গেল যে, رَحْمٰن -এর মধ্যে- رَحِيْم -এর তুলনায় مُبَالَغَة অনেক গুণে বেশী আছে। কিন্তু হাদীসের একটি দু'আর মধ্যে يَا رَحْمٰنَ الدُّنْيَا وَالْاٰخِرَةِ وَرَحِيْمَهُمَا এ ভাবেও এসেছে। রাহমান' নামটি আল্লাহ তা'আলার জন্যেই নির্ধারিত। তিনি ছাড়া আর কারও এ নাম হতে পারে না। যেমন আল্লাহ তাআলার নির্দেশ রয়েছেঃ “আল্লাহকে ডাকো বা রাহমানকে ডাকো, যে নামেই চাও তাঁকে ডাকতে থাকো। তার অনেক ভাল ভাল নাম রয়েছে। অন্য একটি আয়াতে আছেঃ وَ سْـئَـلْ مَنْ اَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رُّسُلِنَاۤ اَجَعَلْنَا مِنْ دُوْنِ الرَّحْمٰنِ اٰلِهَةً یُّعْبَدُوْنَ 


অর্থাৎ তোমার পূর্ববর্তী নবীগণকে জিজ্ঞেস কর যে, রাহমান ছাড়া তাদের কোন মাবুদ ছিল কি যার তারা ইবাদত করতো?' (৪৩:৪৫) মুসাইলামা কায্যাব যখন নবুওয়াতের দাবী করে এবং নিজেকে রাহমানুল ইয়ামামা' নামে অভিহিত করে, আল্লাহ তা'আলা তখন তাকে অত্যন্ত লাঞ্ছিত ও ঘৃণিত করেন এবং চরম মিথ্যাবাদী নামে সে সারা দেশে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। আজও তাকে মুসাইলামা কায্যাব বলা হয় এবং প্রত্যেক মিথ্যা দাবীদারকে তার সাথে তুলনা করা হয়। আজ প্রত্যেক পল্লীবাসী ও শহরবাসী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আবালবৃদ্ধ সবাই তাকে বিলক্ষণ চেনে।


কেউ কেউ বলেন যে, রাহমানের চেয়ে রাহীমের মধ্যেই বেশী مُبَالَغَة  রয়েছে। কেননা, এ শব্দের সঙ্গে পূর্ব শব্দের تَاكِيْد করা হয়েছে, আর যার تَاكِيْد করা হয় তা অপেক্ষা تَاكِيْد ই বেশী জোরদার হয়ে থাকে। এর উত্তর এই যে, এখানে تَاكِيْد -ই হয়নি, বরং এতো صِفَت এবং صِفَت এর মধ্যে এ নিয়ম প্রযোজ্য নয়। সুতরাং আল্লাহ তা'আলার এমন নাম নেয়া হয়েছে যে নামের মধ্যে তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং রাহমানকেই সর্বপ্রথম ওর বিশেষণ রূপে বর্ণনা করা হয়েছে, সুতরাং এ নাম রাখাও অন্যের জন্যে নিষিদ্ধ। যেমন আল্লাহ পাক স্বয়ং বলেছেনঃ “তোমরা আল্লাহকে ডাক বা রাহমানকে ডাকো, যে নামেই চাও ডাকো, তার জন্যে বেশ ভাল ভাল সুন্দর সুন্দর নাম রয়েছে।


মুসাইলামা কাযযাব এ জঘন্যতম আস্পর্ধা দেখালেও সে সমূলে ধ্বংস হয়েছিল এবং তার ভ্রষ্ট সঙ্গীদের ছাড়া এটা অন্যের উপর চালু হয়নি। রাহীম বিশেষণটির সঙ্গে আল্লাহ তা'আলা অন্যদেরকেও বিশেষিত করেছেন। যেমন তিনি বলেছেনঃ لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ عَزِیْزٌ عَلَیْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِیْصٌ عَلَیْكُمْ بِالْمُؤْمِنِیْنَ رَءُوْفٌ رَّحِیْمٌ (৯:১২) এ আয়াতে আল্লাহ তা'আলা স্বীয় নবীকে (সঃ) رَحِيْمٌ বলেছেন। এভাবেই তিনি স্বীয় কতগুলি নাম দ্বারা অন্যদেরকেও স্মরণ করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন (৭৬:২) اِنَّا خَلَقْنَا الْاِنْسَانَ مِنْ نُّطْفَةٍ اَمْشَاجٍ ﳓ نَّبْتَلِیْهِ فَجَعَلْنٰهُ سَمِیْعًۢا بَصِیْرًا 


এখানে আল্লাহ তাআলা মানুষকে سَمِيْعٌ ও بَصِيْرٌ  বলেছেন। মোটকথা এই যে, আল্লাহর কতগুলো নাম এমন রয়েছে যেগুলোর প্রয়োগ ও ব্যবহার অন্য অর্থে অন্যের উপরও হতে পারে এবং কতগুলো নাম আবার আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও উপর ব্যবহৃত হতেই পারে না। যেমন আল্লাহ, রাহমান, খালেক এবং রাজ্জাক ইত্যাদি। এজন্যেই আল্লাহ তা'আলা প্রথম নাম নিয়েছেন আল্লাহ', অতঃপর ওর বিশেষণ রূপে রাহমান এনেছেন। কেননা রাহীমের তুলনায় এর বিশেষত্ব ও প্রসিদ্ধি অনেক গুণে বেশী। আল্লাহ সর্বপ্রথম তার সবচেয়ে বিশিষ্ট নাম নিয়েছেন, কেননা নিয়ম রয়েছে সর্বপ্রথম সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন নাম নেয়া। তারপরে তিনি অপেক্ষাকৃত কম পর্যায়ের ও নিম্ন মানের এবং তারও পরে তদপেক্ষা কমটা নিয়েছেন। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় যে, রাহমানের মধ্যে যখন রাহীম অপেক্ষা مُبَالَغَة বেশী আছে, তখন তাকেই যথেষ্ট মনে করা হয়নি কেন? এর উত্তরে হযরত আতা’ খুরাসানীর (রঃ) এ কথাটি পেশ করা যেতে পারে যে, রহমান রাখতো সেই জন্যে রাহীম শব্দটিও আনা হয়েছে যাতে কোন সংশয়ের অবকাশ না থাকে। রাহমান ও রাহীম শুধু আল্লাহ তা'আলারই নাম। ইমাম ইবনে জারীর (রঃ), একথাটি নকল করেছেন। কেউ কেউ বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা قُلِ ادْعُوا اللّٰهَ اَوِ ادْعُوا الرَّحْمٰنَؕ-اَیًّا مَّا تَدْعُوْا فَلَهُ الْاَسْمَآءُ الْحُسْنٰىۚ (১৭:১১০) এই আয়াতটি অবতীর্ণ করার পূর্বে কুরাইশ কাফিরেরা রাহমানের সঙ্গে পরিচিতিই ছিল না। এ আয়াত দ্বারা আল্লাহপাক তাদের ধারণা খণ্ডন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির বছরেও রাসূলুল্লাহ (সঃ) হযরত আলী (রাঃ) কে বলেছিলেনঃ ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম লিখ।' কাফির কুরাইশরা তখন বলেছিল আমরা রাহমান ও রাহীমকে চিনি না। সহীহ বুখারীর মধ্যে এ বর্ণনাটি রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, তারা বলেছিলঃ “আমরা ইয়ামামার রাহমানকে চিনি, অন্য কাউকেও চিনি না।' এভাবে কুরআন পাকের অন্যত্র রয়েছেঃ وَ اِذَا قِیْلَ لَهُمُ اسْجُدُوْا لِلرَّحْمٰنِ قَالُوْا وَ مَا الرَّحْمٰنُۗ-اَنَسْجُدُ لِمَا تَاْمُرُنَا وَ زَادَهُمْ نُفُوْرًا 


অর্থাৎ যখন তাদেরকে বলা হয়-রাহমানের সামনে তোমরা সিজদাহ কর, তখন তারা আরও হিংস্র হয়ে উঠে এবং বলে-রাহমান কে যে আমরা তোমার কথা মতই তাকে সিজদা করবো?' (২৫:৬০) এ সবের সঠিক ভাব ও তাৎপর্য এই যে, এই দুষ্ট লোকগুলি অহঙ্কার ও শত্রুতার বশবর্তী হয়েই রাহমানকে অস্বীকার করতো, কিন্তু তারা যে রাহমানকে বুঝতে না বা তার সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিল তা নয়। কেননা অজ্ঞতা যুগের প্রাচীন কবিতাগুলোর মধ্যে আল্লাহর এই রাহমান নামটি দেখতে পাওয়া যায়। ওগুলো অজ্ঞতা যুগের ঐসব জাহেলী কবিরই কবিতা। 


হযরত হাসান (রঃ) বলেনঃ রাহমান নামটি অন্যের জন্যে নিষিদ্ধ। ওটা স্বয়ং আল্লাহর নাম। এ নামের উপর লোকের কোন অধিকার নেই।' হযরত উম্মে সালমার (রাঃ) হাদীসটি পূর্বেই বর্ণিত হয়েছে। সেখানে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) প্রত্যেক আয়াতে থামতেন এবং এভাবেই একটা দল বিসমিল্লাহির উপর আয়াত করে তাকে আলাদাভাবে পড়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ মিলিয়েও পড়েন। দুইটি জযম একত্রিত হওয়ায় মীমে যের দিয়ে থাকেন। জমহুরের এটাই অভিমত। কোন কোন আরব মীমকে যবর দিয়ে পড়েন। তারা হামযার’ যবরটি ‘মীমকে দিয়ে থাকেন। যেমন- الٓمَّٓ ـ اللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ইবনে আতিয়্যাহ বলেনঃ “আমার জানা মতে যবরের কিরাআতটি কোন লোক থেকে বর্ণিত হয়নি। 



( পূর্বের আয়াত  )    ( প্রথম পৃষ্ঠা )   ( পরের আয়াত

No comments

Powered by Blogger.