google.com, pub-9578994771857186, DIRECT, f08c47fec0942fa0 01:02: ইবন কাসীর। বাংলা - PDF BOOKS

Header Ads

Header ADS

01:02: ইবন কাসীর। বাংলা

 Al-Fatihah 1:2

ٱلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ ٱلْعَٰلَمِينَ


সাতজন কারীই اَلْحَمْدُ-এর دَال কে পেশ দিয়ে পড়ে থাকেন এবং اَلْحَمْدُ لِلَّهِ কে مُبْتَدَاء وَخَبَر বা উদ্দেশ্য ও বিধেয় বলে থাকেন। সুফইয়ান বিন উয়াইনা এবং রু’বাহ বিন আফ্যাজের মতে ‘দাল’ যবরের সঙ্গে হবে এবং এখানে ক্রিয়াপদ উহ্য রয়েছে। ইবনে আবী ইবলাহ اَلْحَمْدُ-এর দল কে ও لِلهِ-এর প্রথম ‘লাম’ এদুটোকেই পেশ দিয়ে পড়ে থাকেন এবং এ লামটিকে প্রথমটির تَابِع করে থাকেন। যদিও আরবদের ভাষায় এর প্রমাণ বিদ্যমান, তথাপি এটা সংখ্যায় অতি নগণ্য। হযরত হাসান (রঃ) এবং হযরত যায়েদ ইবনে আলী (রঃ) এই দুই অক্ষরকে যের দিয়ে পড়ে থাকেন এবং দাল’ কে ‘লামের' تَابِع করেন। 


ইমাম ইবনে জারীর (রঃ) বলেন যে, اَلْحَمْدُ لِله-এর অর্থ এই যে, কৃতজ্ঞতা শুধু আল্লাহর জন্যে, তিনি ছাড়া আর কেউ এর যোগ্য নয়, সে সৃষ্ট জীবের মধ্যে যে কেউ হোক না কেন। কেননা, সমুদয় দান যা আমরা গণনা করতে পারি না এবং তার মালিক ছাড়া কারও সেই সংখ্যা জানা নেই, সবই তার কাছ থেকেই আগত। তিনিই তার আনুগত্যের সমুদয় মালমসলা আমাদেরকে দান করেছেন। আমরা যেন তাঁর আদেশ ও নিষেধ মেনে চলতে পারি সেজন্যে তিনি আমাদেরকে শারীরিক সমুদয় নিয়ামত দান করেছেন। অতঃপর ইহলৌকিক অসংখ্য নিয়ামত এবং জীবনের সমস্ত প্রয়োজন আমাদের অধিকার ছাড়াই তিনি আমাদের নিকট না চাইতেই পৌছিয়ে দিয়েছেন। তার সদা বিরাজমান অনুকম্পা এবং তার প্রস্তুতকৃত পবিত্র সুখের স্থান, সেই অবিনশ্বর জান্নাত আমরা কিভাবে লাভ করতে পারি তাও তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন। সুতরাং আমরা এখন নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, এসবের যিনি মালিক, প্রথম ও শেষ সমুদয় কৃতজ্ঞতা একমাত্র তাঁরই ন্যায্য প্রাপ্য। এটা একটা প্রশংসামূলক বাক্য। আল্লাহ পাক নিজের প্রশংসা নিজেই করেছেন এবং ঐ প্রসঙ্গেই তিনি যেন বলে দিলেনঃ তোমরা বল اَلْحَمْدُ لِله 


অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্যে।' কেউ কেউ বলেন যে, আলহামদু লিল্লাহ' বলে আল্লাহ তা'আলার পবিত্র নাম ও বড় বড় গুণাবলীর দ্বারা তার প্রশংসা করা হয়। আর اَلشُّكْرُ لِلهِ বলে তার দান ও অনুগ্রহের জন্যে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু একথাটি সঠিক নয়। কেননা আরবী ভাষায় যারা পাণ্ডিত্য অর্জন করেছেন তারা এ বিষয়ে এক মত যে, شُكْر-এর স্থলে حَمْد ও حَمْد-এর স্থলে- شُكْر ব্যবহৃত হয়ে থাকে। জাফর সাদিক এবং ইবনে আতা' প্রমুখ সুফীগণ এটাই বলে থাকেন। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, প্রত্যেক কৃতজ্ঞের কৃতজ্ঞতা প্রকাশক কথা হলো اَلْحَمْدُ لِلهِ, কুরতুবী (রঃ) ইবনে জারীরের (রঃ) কথাকে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ করার জন্যে এ দলীল বর্ণনা করেছেন যে, যদি কেউ اَلْحَمْدُ لِلهِ شُكْرًا বলে তবে ওটাও নির্ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে আল্লামা ইবনে জারীরের কথায় পূর্ণ সমালোচনা ও পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। পরবর্তী যুগের আলেমদের মধ্যে এটা প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, প্রশংসিত ব্যক্তির প্রত্যক্ষ গুণাবলীর জন্য বা পরোক্ষ গুণাবলীর জন্য মুখে তার প্রশংসা করার নাম হামদ। আর শুধুমাত্র পরোক্ষ গুণাবলীর জন্যে তার প্রশংসা করার নাম শুকর এবং তা অন্তঃকরণ, জিহ্বা এবং কাজের দ্বারাও করা হয়। আরব কবিদের কবিতাও এর সাক্ষ্য ও দলীলরূপে পেশ করা যেতে পারে। তবে حَمْد শব্দটি عَام কি شُكْر শব্দটি عَام এ বিষয়ে কিছুটা মতভেদ বিদ্যমান রয়েছে। সঠিক ও অভ্রান্ত কথা এই যে, ওদের মধ্যে عُمُوْم ও خُصُوْص-এর সম্পর্ক রয়েছে। এক দিক দিয়ে حَمْد শব্দটি شُكْر শব্দ হতে عَام কেননা এটা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় গুণের সাথেই সমভাবে সম্পর্কিত ও সংযুক্ত। পবিত্রতা ও দান উভয়ের জন্যেই حَمَدْتُّهٗ বলা চলে। আবার শুধু জিহ্বা দিয়ে তা আদায় করা হয় বলে এটা خَاص এবং شُكْر শব্দটি হচ্ছে عَام, কেননা ওটা কথা কাজ ও অন্তঃকরণ -এ তিনটার উপরেই সমানভাবে বলা হয়। আবার পরোক্ষ গুণের উপর বলা হয় বলে شُكْر শব্দটি خَاص পবিত্রতার উপর شَكَرْتُهٗ বলা হয় না বরং شَكَرْتُهٗ عَلٰى كَرَمِهٖ وَاِحْسَانِهٖ اِلٰى একথা বলা যেতে পারে। আল্লাহ তাআলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল জানেন। 


আবু নসর ইসমাইল বিন হাম্মাদ জওহারী (রঃ) বলেন যে, حَمْد অর্থাৎ প্রশংসা শব্দটি ذَم অর্থাৎ তিরস্কারের উল্টা। বলা হয়- حَمَدْتُّ الرَّجُلَ اَحْمَدُهٗ وَمَحْمَدَةً فَهُوَ حَمِيْدٌ وَمَحْمُوْدٌ


تَحْمِيْد-এর মধ্যে حَمْد-এর চেয়েও বেশী مُبَالَغَه বা আধিক্য রয়েছে حَمْد শব্দটি شُكْر  শব্দ হতে عَام, দাতার দানের উপর তার প্রশংসা করাকে আরবী ভাষায় شُكْر বলা হয়। شُكِرْتُهٗ এবং شَكَرْتُ لَهٗ এ দু’ভাবেই প্রয়োগ করা চলে। কিন্তু লামের সঙ্গে বলাই বেশী সমীচীন ও শোভনীয়। مَدْح শব্দটি حَمْد হতেও বেশী عَام, কেননা জীবিত ও মৃত এমনকি জড় পদার্থের উপরেও مَدْح শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অনুগ্রহের পূর্বে ও পরে, প্রত্যক্ষ গুণাবলীর উপর ও পরোক্ষ গুণাবলীর উপর তার ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে বলেই ওর عَام হওয়া সাব্যস্ত হলো। অবশ্য এ সম্পর্কে আল্লাহ তা'আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন।


حَمْدٌ ‘হামদ’ শব্দের তাফসীর ও পূর্বযুগীয় গুরুজনদের অভিমতঃ 


হযরত উমার (রাঃ) একবার বলেছিলেনঃ سُبْحَانَ اللهِ ও لَااِلٰهَ اِلَّااللهُ এবং কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, اَللهُ اَكْبَرُ কে আমরা জানি, কিন্তু اَلْحَمْدُ لِلهِ এর ভাবার্থ কি? হযরত আলী (রাঃ), উত্তরে বললেনঃ আল্লাহ তাআলা এ কথাটিকে নিজের জন্যে পছন্দ করেছেন এবং কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, এটা বললে আল্লাহকে খুবই ভাল লাগে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ “এটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশক বাক্য। এর উত্তরে আল্লাহ তা'আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। সুতরাং এই কথাটির মধ্যে শুকর ছাড়া আল্লাহর দানসমূহ, হেদায়াত, অনুগ্রহ প্রভৃতির স্বীকারোক্তি রয়েছে। হযরত কা'ব আহ্বারের (রাঃ) অভিমত এই যে, একথাটি আল্লাহ তা'আলার প্রশংসা। হযরত যহ্হাক (রঃ) বলেন যে, এটা আল্লাহ পাকের চাদর। একটা হাদীসে একথাও আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “তোমরা اَلْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ বললেই আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়ে যাবে। এখন তিনি তোমাদের উপর বরকত দান করবেন।


হযরত আসওয়াদ বিন সারী’ (রাঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর খিদমতে আরয করেনঃ “আমি মহান আল্লাহর প্রশংসার কয়েকটি কবিতা রচনা করেছি। অনুমতি পেলে শুনিয়ে দেবো। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বললেনঃ “আল্লাহ তা'আলা নিজের প্রশংসা শুনতে পছন্দ করেন। মুসনাদ-ই-আহমাদ, সুনান-ই নাসায়ী, জামেউত তিরমিযী এবং সুনান-ই-ইবনে মাজাহয় হযরত জাবির বিন আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ সর্বোত্তম যিকর হচ্ছে لَااِلٰهَ اِلَّااللهُ এবং সর্বোত্তম প্রার্থনা হচ্ছে اَلْحَمْدُ لِلهِ, ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে পরিভাষা অনুযায়ী হাসান গারীব' বলে থাকেন। 


সুনান-ই-ইবনে মাজাহয় রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কিছু দান করার পর যদি সে তার জন্যে আলহামদুল্লিাহ' পাঠ করে তবে তার প্রদত্ত বস্তুই গৃহীত বস্তু হতে উত্তম হবে। আল্লাহর রাসূল (সঃ) আরও বলেনঃ “যদি আল্লাহ আমার উম্মতের মধ্যে কোন লোককে দুনিয়া দান করেন এবং সে যদি তার জন্য আলহামদুল্লিাহ' পাঠ করে তবে এ কথাটি সমস্ত দুনিয়া জাহান হতে উত্তম হবে।' কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ


এর ভাবার্থ এই যে, আল হামদুলিল্লাহ' বলার তাওফীক লাভ যত বড় নিয়ামত, সারা দুনিয়া জাহান দান করাও ততো বড় নিয়ামত নয়। কেননা দুনিয়া তো নশ্বর ও ধ্বংসশীল, কিন্তু একথার পুণ্য অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। যেমন পবিত্র কুরআনের মধ্যে রয়েছেঃ اَلْمَالُ وَ الْبَنُوْنَ زِیْنَةُ الْحَیٰوةِ الدُّنْیَاۚ-وَ الْبٰقِیٰتُ الصّٰلِحٰتُ خَیْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَّ خَیْرٌ اَمَلًا


অর্থাৎ “ধনদৌলত ও সন্তান সন্ততি দুনিয়ার সৌন্দর্য মাত্র, কিন্তু সত্যার্যাবলী চিরস্থায়ী পুণ্য বিশিষ্ট এবং উত্তম আশাবাহক।' (১৮:৪৬) সুনান-ই-ইবনে মাজাহর মধ্যে হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ একদা এক ব্যক্তি এই দু'আ পাঠ করলোঃ يَارَبِّ لَكَ الْحَمْدُ كَمَا يَنْبَغِىْ لِجَلَالِ وَجْهِكَ وَقَدِيْمِ سُلْطَانِكَ


এতে ফেরেশতাগণ পুণ্য লিখার ব্যাপারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। অবশেষে তারা আল্লাহ পাকের নিকট আরয করলেনঃ আপনার এক বান্দা এমন একটা কালেমা পাঠ করেছে যার পুণ্য আমরা কি লিখবো বুঝতে পারছি না। বিশ্ব প্রভু সব কিছু জানা সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করলেনঃ “সে কী কথা বলেছে?' তাঁরা বললেন যে, সে এই কালেমা বলেছে। তখন আল্লাহ তা'আলা বললেনঃ “সে যা বলেছে তোমরা হুবহু তাই লিখে নাও। আমি তার সাথে সাক্ষাতের সময়ে নিজেই তার যোগ্য প্রতিদান দেবো।'


কুরতুবী (রঃ) আলেমদের একটি দল হতে নকল করেছেন যে, “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু' হতেও আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ উত্তম। কেননা, এর মধ্যে অহূদানিয়্যাত বা একত্ববাদ ও, প্রশংসা দুটোই রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য আলেমগণের ধারণা এই যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ই উত্তম। কেননা ঈমান ও কুফরের মধ্যে এটাই পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়। আর এটা বলাবার জন্যই কাফিরদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের মধ্যে রয়েছে। আরও একটি মারফু হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ আমি এবং আমার পূর্ববর্তী নবীগণ যা কিছু বলেছি তার মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু অহ্দাহু লা শারীকালাহু।”  


হযরত জাবিরের (রাঃ) একটি মারফু হাদীস ইতিপূর্বেই বর্ণিত হয়েছে যে, সর্বোত্তম যিক্র হলো ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ এবং সর্বোত্তম প্রার্থনা হলো আল হামদু লিল্লাহ'। ইমাম তিরমিযী (রঃ) এ হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। ‘আল হামদু’র আলিফ লাম ইসতিগরাকের জন্যে ব্যবহৃত অর্থাৎ সমস্ত প্রকারের হামদ' বা স্ততিবাদ একমাত্র আল্লাহর জন্যেই সাব্যস্ত। যেমন হাদীসে রয়েছেঃ “হে আল্লাহ! সমুদয় প্রশংসা তোমারই জন্যে, সারা দেশ তোমারই, তোমারই হাতে সামগ্রিক মঙ্গল নিহিত রয়েছে এবং সমস্ত কিছু তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করে থাকে।


সর্বময় কর্তাকে রব' বলা হয় এবং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নেতা এবং সঠিকভাবে সজ্জিত ও সংশোধনকারী। এসব অর্থ হিসেবে আল্লাহ তা'আলার জন্যে এ পবিত্র নামটিই শোভনীয় হয়েছে। রব’ শব্দটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও জন্যে ব্যবহৃত হতে পারে না। তবে সম্বৰূপদরূপে ব্যবহৃত হলে সে অন্য কথা। যেমন رَبُّ الدَّرِ বা গৃহস্বামী ইত্যাদি। কারো কারো মতে এটাই ইসমে আযম। عَالَمِيْنَ শব্দটি عَالَمٌ শব্দের বহু বচন। আল্লাহ ছাড়া সমুদয় সৃষ্টবস্তুকে عَالَم বলা হয়। عَالَم শব্দটিও বহু বচন এবং এ শব্দের এক বচনই হয় না। আকাশের সৃষ্টজীব এবং জল ও স্থলের সৃষ্টজীবকেও عَوَالِم অর্থাৎ কয়েকটি عَالَم  বলা হয়। অনুরূপভাবে এক একটি যুগ-কাল ও এক একটি সময়কেও عَالَم বলা হয়।


হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে এ আয়াতের তাফসীরে বর্ণিত হয়েছে যে, এর দ্বারা সমুদয় সৃষ্টজীবকেই বুঝায়, নভোমণ্ডলেরই হোক বা ভূমণ্ডলের হোক অথবা এ দুয়ের মধ্যবর্তী জায়গারই হোক এবং তা আমাদের জানাই হোক বা অজানাই থাকে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতেই এর ভাবার্থরূপে দানব ও মানব বর্ণিত হয়েছে। হযরত সাঈদ বিন যুবাইর (রঃ), হযরত মুজাহিদ (রঃ) এবং ইবনে জুরাইজ (রঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে। হযরত আলী (রাঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে কিন্তু সনদ হিসেবে এটা নির্ভরযোগ্য নয়। একথার দলীলরূপে কুরআন পাকের এ আয়াতটিও বর্ণনা করা হয়েছেঃ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيْرًا অর্থাৎ ‘যেন তিনি আলামীনের জন্যে অর্থাৎ দানব ও মানবের জন্যে ভয় প্রদর্শক হয়ে যান।' ফারা (রঃ) ও আবু উবায়দার (রঃ) মতে প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন প্রাণীকে ‘আলাম বলা হয়। দানব, মানব ও শয়তানকে ‘আলাম বলা হবে। জন্তুকে ‘আলাম বলা হবে না। হযরত যায়েদ বিন আসলাম (রঃ) এবং হযরত আবু মাহীসেন (রঃ) বলেন যে, প্রত্যেক প্রাণীকেই ‘আলাম বলা হয়। হযরত কাতাদাহ (রঃ) বলেন যে, প্রত্যেক শ্রেণীকে একটা আলাম বলা হয়।


ইবনে মারওয়ান বিন হাকাম উরফে জা’দ, যার উপাধি ছিল হিমার, যিনি বানূ উমাইয়াদের আমলে একজন খলীফা ছিলেন, তিনি বলেনঃ “আল্লাহ তা'আলা সতেরো হাজার ‘আলম সৃষ্টি করেছেন। আকাশে অবস্থিত সবগুলো একটা ‘আলম, যমীনে অবস্থিত সবগুলো একটা আলম এবং বাকীগুলো আল্লাহ তা'আলাই জানেন। মানুষের নিকট ওগুলো অজ্ঞাত।' আবুল ‘আলিয়া (রঃ) বলেন যে, সমস্ত মানুষ একটা ‘আলম, সমস্ত জ্বিন একটা ‘আলম, এবং এ দুটো ছাড়া আরো আঠারো হাজার বা চৌদ্দ হাজার ‘আলম রয়েছে। ফেরেশতাগণ যমীনের উপর আছেন। যমীনের চারটি প্রান্ত রয়েছে এবং প্রত্যেক প্রান্তে সাড়ে তিন হাজার ‘আলম রয়েছে। তাদেরকে আল্লাহ তা'আলা শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এ বর্ণনাটি সম্পূর্ণ গারীব বা অপরিচিত। এ ধরনের কথা যে পর্যন্ত না সহীহ দলীল ও অকাট্য প্রমাণ দ্বারা সাব্যস্ত হয়, আদৌ মানবার যোগ্য নয়। রাব্বল আলামীন’র ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হুমাইরী (রঃ) বলেন যে, বিশ্বজাহানে এক হাজার জাতি রয়েছে। ছয়শো আছে জলে, আর চারশো আছে স্থলে। সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব (রঃ) হতেও এটা বর্ণিত হয়েছে। 


একটা দুর্বল বর্ণনায় আছে যে, হযরত উমার ফারূকের (রাঃ) খিলাফত কালে এক বছর ফড়িং দেখা যায়নি। এমনকি অনুসন্ধান করেও এর কোন পাত্তা মিলেনি। তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন এবং সিরিয়া ও ইরাকে অশ্বারোহী পাঠিয়ে দিলেন এজন্য যে, কোনও স্থানে ফড়িং দেখা যায় কিনা। ইয়ামন যাত্রী অল্প বিস্তর ফড়িং ধরে এনে আমীরুল মুমেনীনের সামনে হাযির করলেন। তিনি তা দেখে তাকবীর ধ্বনি করলেন এবং বললেন আমি রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে বলতে শুনেছিঃ “আল্লাহ তা'আলা এক হাজার জাতি সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্য ছয়শো পানিতে, চারশো স্থলে। তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম যে জাতি ধ্বংস হবে তা হবে ফড়িং। অতঃপর ক্রমাগত সব জাতিই একে একে ধ্বংস হয়ে যাবে যেমনভাবে তসবীহের সূতা কেটে গেলে দানাগুলি ক্রমাগত ঝরে পড়ে। কিন্তু এ হাদীসের রাবী বা বর্ণনাকারী মুহাম্মদ বিন ঈসা হিলালী দুর্বল। হযরত সাঈদ বিন মুসাইয়্যেব (রঃ) হতেও এটা বর্ণিত আছে। 


ওয়াহিব বিন মামবাহ বলেন যে, আঠারো হাজার ‘আলামের মধ্যে সারা। দুনিয়া একটি ‘আলম। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, চল্লিশ হাজার ‘আলামের মধ্যে সারা দুনিয়া একটা ‘আলম। যাযাজ (রঃ) বলেন যে, আল্লাহ তা'আলা ইহজগত ও পরজগতে যা কিছু সৃষ্টি করেছেন সবই ‘আলম। কুরতুবী (রঃ) বলেন যে, এ মতটিই সত্য। কেননা এর মধ্যে সমস্ত ‘আলমই জড়িত রয়েছে। যেমন ফিরআউনের বিশ্বপ্রভু কৈ' এই প্রশ্নের উত্তরে হযরত মূসা (আঃ) বলেছিলেনঃ ‘আসমান, যমীন এবং এ দুয়ের মধ্যে স্থলে যা কিছু আছে সবারই তিনি প্রভূ।'


عَالَم শব্দটি عَلَامَت শব্দ হতে নেওয়া হয়েছে। কেননা, আলম সৃষ্ট বস্তু তার সৃষ্টিকারীর অস্তিত্বের পরিচয় বহন করে এবং তাঁর একত্ববাদের চিহ্নরূপে কাজ করে থাকে। যেমন কবি ইবনে মুতায এর কথাঃ فَيَاعَجَبًا كَيْفَ يَعْصِى الْاِلٰهَ ـ اَمْ كَيْفَ يَجْحَدُهُ الْجَاحِدُ ـ وَفِىْ كُلِّ شَىْءٍ لَهٗ اٰيَةٌ ـ تَدُلُّ عَلٰى اَنَّهٗ وَاحِدٌ


অর্থাৎ আল্লাহর অবাধ্য হওয়া বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে, এবং এটাও বিস্ময়জনক যে, কিভাবে অস্বীকারকারী তাকে অস্বীকার করছে। অথচ প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই এমন স্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে যা প্রকাশ্যভাবে তার একত্ববাদের পরিচয় বহন করছে।




।।।।

No comments

Powered by Blogger.