02:04,ইবন কাসীর, বাংলা,
Al-Baqarah 2:4
وَٱلَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَآ أُنزِلَ إِلَيْكَ وَمَآ أُنزِلَ مِن قَبْلِكَ وَبِٱلْءَاخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন যে, এর ভাবার্থ হচ্ছেঃ তুমি তোমার প্রভু আল্লাহ তা'আলার নিকট হতে যা কিছু এনেছে এবং তোমার পূর্ববর্তী নবীগণ (আঃ) যা কিছু এনেছিলো তারা ঐ সমুদয়ের সত্যতা স্বীকার করে। এ নয় যে, কোনটা মানে ও কোনটা মানে না, বরং প্রভুর সমস্ত কথাই বিশ্বাস করে এবং পরকালের উপরও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।' অর্থাৎ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মীযান ইত্যাদি সমস্তই পূর্ণভাবে বিশ্বাস করে। কিয়ামত দুনিয়া ধ্বংসের পরে আসবে বলে তাকে আখেরাত বলা হয়েছে। কোন কোন মুফাসির বলেছেন যে,পূর্বে যাদের অদৃশ্যের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ইত্যাদি বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে, তাদেরই দ্বিতীয় বার এই বিশেষণ বর্ণনা করা হয়েছে।
অর্থাৎ ঈমানদার আরবেরই মুমিন হোক বা আহলে কিতাব হোক বা অন্য যে কোন হোক। মুজাহিদ (রঃ), আবুল আলিয়া (রঃ), রাবী' বিন আনাস (রঃ) এবং কাতাদার (রঃ) এটাই মত। কেউ কেউ বলেছেন যে, এ দুটো একই কিন্তু এ থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে আহলে কিতাব। এই দুই অবস্থায় وَاؤ টি عَطْف এর وَاؤ হবে এবং صِفَت এর عَطف হবে صِفَت উপর। যেমন- (৮৭:১-৪) سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْاَعْلَى(-) الَّذِیْ خَلَقَ فَسَوّٰى(-) وَ الَّذِیْ قَدَّرَ فَهَدٰى(-) وَ الَّذِیْۤ اَخْرَ جَ الْمَرْعٰى
এখানে صِفَت-এর عَطْف হয়েছে صِفَت-এর উপর। এই প্রকারের عَطْف বা সংযোগ কবিদের কবিতাতেও এসেছে। তৃতীয় মত এই যে, প্রথম صِفَت তো হচ্ছে আরব মুমিনদের এবং وَ الَّذِیْنَ یُؤْمِنُوْنَ بِمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ وَ مَاۤ اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَۚ-وَ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ-হতে আহলে কিতাবের মুমিনদের صِفَت ধরা হবে। কুরআন বিশারদ মনীষী হযরত সুদী (রঃ) এটা হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ), হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) এবং অন্যান্য কয়েকজন সাহাবী (রাঃ) হতে নকল করেছেন এবং আল্লামা ইবনে জারীরও (রাঃ) এটাকেই পছন্দ করেছেন। এর প্রমাণ স্বরূপ তিনি এই আয়াতটি এনেছেনঃ وَاِنَّ مِنْ اَهْلِ الْكِتٰبِ لَمَنْ یُّؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكُمْ وَمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْهِمْ خٰشِعِیْنَ لِلّٰهِ
অর্থাৎ বস্তুতঃ আহলে কিতাবের মধ্যে এমন লোকও আছে যে আল্লাহ তাআলার উপর এবং যা তোমাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর ও যা তাদের উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার উপরও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে ভয় করে। (৩:১৯৮) অনুরূপ ভাবে আরও এক জায়গায় ইরশাদ হয়েছেঃ
اَلَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلِهٖ هُمْ بِهٖ یُؤْمِنُوْنَ ـ وَ اِذَا یُتْلٰى عَلَیْهِمْ قَالُوْۤا اٰمَنَّا بِهٖۤ اِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّنَاۤ اِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهٖ مُسْلِمِیْنَ ـ اُولٰٓىٕكَ یُؤْتَوْنَ اَجْرَهُمْ مَّرَّتَیْنِ بِمَا صَبَرُوْا وَ یَدْرَءُوْنَ بِالْحَسَنَةِ السَّیِّئَةَ وَ مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ یُنْفِقُوْنَ
অর্থাৎ যাদেরকে আমি এর পূর্বে কিতাব দিয়েছিলাম তার উপর তারা ঈমান এনে থাকে এবং যখন তাদের নিকট কুরআন পাঠ করা হয় তখন তারা বলেআমরা এর উপর ঈমান আনলাম এবং আমাদের প্রভুর তরফ হতে সত্যরূপে বিশ্বাস করলাম, আমরা এর পূর্বেই তো মুসলমান ছিলাম। তাদেরকে তাদের ধৈর্যের বিনিময়ে ও মন্দের পরিবর্তে ভাল করার এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করার বিনিময়ে দ্বিগুণ প্রতিদান দেয়া হবে।' (২৮:৫২-৫৪)
এ ছাড়া সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত আবু মূসা আশআরী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, তিন ব্যক্তিকে তাঁদের কাজের বিনিময়ে দ্বিগুণ পুণ্য দেয়া হবেঃ (১) ঐ আহলে কিতাব-যে তার নবীর (আঃ) উপর ঈমান এনেছে এবং সেই সঙ্গে আমার উপরও ঈমান রেখেছে। (২) সেই কৃতদাস-যে আল্লাহর হক আদায় করে এবং স্বীয় মনিবেরও হক আদায় করে। (৩) ঐ ব্যক্তি-যে তার দাসীকে ভালভাবে শিক্ষা দিয়ে তাকে আযাদ করে দেয়, অতঃপর তাকে বিয়ে করে। ইমাম ইবনে জারীরের (রঃ) এই পার্থক্যের সম্বন্ধ এর দ্বারাও জানা যায় যে, এ সূরার প্রথমে মুমিন ও কাফিরের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেমন কাফিরের দুটি অংশ আছে, কাফির ও মুনাফিক, দ্রুপ মুমিনদেরও দুটি ভাগ রয়েছে, আরবী মুমিন ও কিতাবী মুমিন। আমি বলি-বাহ্যিক দৃষ্টিতে বুঝা যায় যে, মুজাহিদের একথাটিই সঠিকঃ সূরা-ই- বাকারার প্রথম চারটি আয়াতে মুমিনদের আলোচনা আছে, এবং তার পরবর্তী তেরোটি আয়াতে মুনাফিকদের সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং এ চারটি আয়াত প্রত্যেক মুমিনের জন্যে সাধারণ বা সমভাবে প্রযোজ্য। সে আরবী হোক আযমী হোক, কিতাবী হোক, মানবের মধ্যে হোক বা দানবের মধ্যেই হোক না কেন। কারণ, এর মধ্যে প্রত্যেকটি গুণ অন্যের ক্ষেত্রেই একেবারে জরুরী শর্ত। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটা হতেই পারে না। অদৃশ্যের উপর ঈমান আনা, নামায প্রতিষ্ঠা করা এবং যাকাত দেয়া শুদ্ধ নয়, যে পর্যন্ত না রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর উপর এবং পূর্ববর্তী নবীগণের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল তার উপর ঈমান আনবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পরকালের উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে। যেমন প্রথম তিনটি পরবর্তী তিনটি ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য নয়। দ্রুপ, পরবর্তী তিনটিও পূর্ববর্তী তিনটি ছাড়া পরিশুদ্ধ হয় না। এই জন্যে ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহ পাকের নির্দেশ হচ্ছেঃ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উপর, তাঁর রাসূলের উপর, তাঁর রাসূলের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে তার উপর এবং পূর্বে যে কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল তার উপর বিশ্বাস স্থাপন কর।' অন্য জায়গায় আল্লাহ তা'আলা বলেন, অত্যাচারী ছাড়া সমস্ত আহলে কিতাবের সঙ্গে ঝগড়ার ব্যাপারে তোমরা উত্তম পন্থা অবলম্বন কর এবং বল-আমাদের উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপর এবং তোমাদের উপর যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপরও আমরা সমভাবে বিশ্বাস স্থাপন করছি; আমাদেরও তোমাদের ইবাদতের প্রভু একই।
পবিত্র কুরআনের আর এক স্থানে ঘোষিত হয়েছেঃ “হে আহলে কিতাব! তোমাদের উপর আমি যা অবতীর্ণ করেছি তার উপর তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর, এটা তোমাদের নিকট যা আছে তার সত্যতা স্বীকারকারী।' অন্য জায়গায় আছে, “হে আহলে কিতাব! তোমরা কোন জিনিসের উপরই নও যে পর্যন্ত না তোমরা তাওরাত, ইঞ্জীল এবং যা তোমাদের প্রভুর নিকট হতে তোমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত রাখো।' অন্য জায়গায় সমস্ত ঈমানদারকে সংবাদ প্রদান রূপে কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক বলেছেনঃ “আল্লাহর রাসূল (সঃ) বিশ্বাস রাখে সেই বিষয়ের প্রতি যা তার প্রতি তার প্রভুর পক্ষ হতে নাযিল করা হয়েছে এবং মুমিনগণও সকলেই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি এবং তার বার্তাবাহকগণের প্রতি এই মর্মে যে, আমরা তাঁর রাসূলগণের মধ্যে কাউকেও কোন পার্থক্য করি। আল্লাহ রাব্বল আলামীন আরও বলেছেনঃ যারা আল্লাহর উপর ও তার রাসূলগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং রাসূলদের (আঃ) মধ্যে কাউকেও কোন পার্থক্য করে না। এ বিষয়ে আরও বহু আয়াত রয়েছে যার মধ্যে প্রত্যেক মুসলমানের আল্লাহর উপর, তাঁর সমস্ত রাসূলের উপর এবং সমস্ত কিতাবের উপর ঈমান আনার কথা স্পষ্টাক্ষরে উল্লেখ করা হয়েছে। আহলে কিতাবের ঈমানদারগণের যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে তা অবশ্য একটা অন্য কথা। কেননা তাদের কিতাবের উপর তাদের ঈমান হয় পূর্ণ পরিণত। অতঃপর যখন তারা রাসূলুল্লাহ (সঃ)-এর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে তখন কুরআন কারীমের উপরও তাদের ঈমান পূর্ণ পরিণত হয়ে থাকে। এ জন্যই তারা দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী হয়। এই উম্মতের লোকেরও পূর্ববর্তী কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনে বটে, কিন্তু তাদের ঈমান হয় সংক্ষিপ্ত আকারে। যেমন সহীহ হাদীসের মধ্যে আছে, আল্লাহর রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ ‘আহলে কিতাব তোমার নিকট কোন সংবাদ প্রচার করলে তোমরা তাকে সত্যও বল না আর মিথ্যাও বল না বরং বলে দাও-যা কিছু আমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপরও বিশ্বাস করি এবং যা কিছু তোমাদের উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে তার উপরও আমরা বিশ্বাস রাখি।' কোন কোন স্থলে এমনও হয়ে থাকে যে, যারা রাসূলুল্লাহ (সঃ) -এর উপর ঈমান আনে, তুলনামূলকভাবে আহলে কিতাব অপেক্ষা তাদের ঈমানই বেশী পূর্ণ ও দৃঢ় হয়। এই হিসেবে তারা হয় তো আহলে কিতাব অপেক্ষা বেশী পুণ্য লাভ করবে; যদিও তারা তাদের নবীর (আঃ) উপর এবং শেষ নবীর (সঃ) উপর ঈমান আনার কারণে দ্বিগুণ পুণ্যের অধিকারী। কিন্তু এরা ঈমানের পরিপক্কতার কারণে পুণ্যে তাদেরকেও ছাড়িয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলাই এ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী জানেন।
===
No comments